সেই কবে যেন একবার লালবাগ কেল্লা গিয়েছিলাম শেষবার,
তাও ঠিকঠাক হিসেবে ৯ বছর আগে হবে। সেবার গিয়ে প্রায় পুরোটা আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে
দেখেছিলাম আর শুধু মনে হয়েছিলঃ “আহা! কী ঐশর্যই না ছিল আমাদের আর কী তীব্র আবহেলাই
না করছি আমরা!”
আমার কেন যেন মনে হয় উপার্জনের চিন্তা না থাকলে আমি
সত্যি যদি কিছু হতে চাইতাম সেটা হচ্ছে ‘আর্কিওলজিস্ট’! সেই একই জনপদ, একই আকাশ,
একই চাঁদ-তারা-সূর্য, একটু অন্যভাবে বলতে গেলে জিপিএস হিসেব করলেও সেই একই জায়গা
পাওয়া যাবে কিন্তু শুধু বদলে যাওয়া সময়ের সাথে বদলে যায় ‘নশ্বর’ মানুষগুলো আর
চারপাশ। রেখে যায় কত আনন্দ-বেদনাকাব্য; যা কিছু বর্ত্মান একসময় সব ইতিহাস হয়ে যায়।
নতুন সময় আসে, সভ্যতা আবার নতুন করে চলে, আবারো তৈরী হয় নতুন ইতিহাস!
সেই কবিতার মত “তারপর ইতিহাস হব” , আসলেই তারপর সব ইতিহাস হবার গল্পগুলো কী চমৎকার
মোহময়ই না হয়! যাকগে সে কথা! আমি আসি এখনকার কথায়!
তো গতবারেই দেখেছিলাম কিছু সংস্কার কাজ শুরু
হয়েছিল, হাতুড়ির ঠুকঠুক চলছিল আর একদিকের দেয়ালে তীব্র লাল রঙ দেয়া হচ্ছিল (যেটা
তখন জেলখানার গায়ে দেখেছিলাম)। আমার ব্যাপারটা ভালো লাগেনাই তখনই, আমার মনে হত ‘এই
তো সেই ইট যা সেই কবেকার কোন সময়ে গাঁথা, তখনকার ধূলোবালি-ঝড়-ঝঞ্ঝা বুকে নিয়েই সময়ের
সাক্ষী হয়ে এতদিন টিকে আছে, বয়সের হিসেবে তো ওকে আমার দাদাও “আপনি” বলে ডাকবে! সেই
ইটগুলো তো আর সামান্য ইট না, তার চাইতে বেশী কিছু! সেগুলোকে যখন সংস্কারের নামে
কিছু রাজমিস্ত্রি ভেঙ্গে ফেলে, আমি মেনে নিতে পারিনা! আমার মনে হয় ওগুলোকে কেবল
নরম ব্রাশ দিয়েই ছোঁয়া সম্ভব!
এবার গিয়ে দেখলাম বেশ পরিবর্তন বোঝা যায়, সেইসব
বাতিল ইট ফেলে দিয়ে ওসব যায়গায় নতুন ইট বসেছে আর অনেক গাছপালা দিয়ে এর একটা নতুন
আকর্ষণ নিয়ে আসা হয়েছে। “সাধারণ” দর্শকেরা এতে আকৃষ্ট হয়, ব্যাপারটা ভালো একটা চোখ
“জুড়ানো ব্যপার” আছে। “সাধারণ দর্শক” বলছি এ কারণে যে আমি দেখেছি ঐসব জায়গাই
বেশীরভাগ লোকেই যায় হাটার জন্য আর “দাঁতের কাজ” করার জন্য! (“মুখের কাজ” বললেও
খারাপ বলা হয়না, তবে “হাতের কাজ” বললে লোকে ভুলে বুঝবে!) তারা চারপাশ দেখে আর বলেঃ
“ধ্যূত! কই আসলাম দেখার কিছু নাই! খালি কয়টা হাড়ি-বাটি আর একটা কব্বর!” যেমনটা
লোকে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে বলেঃ “ধুর কি দেখব! দেখার আছেটা কি! শুধু বালি আর পানি
এইতো!?”
আগেরবারের হাম্মামখানা দেখে তো আমি থ! এত্তবড়
জায়গায় নাকি একজন গোসল করতে আসত আর তার জন্য আবার গরম পানি আনা হত কি আয়োজন করেই! শুধু
গরম পানিই না, এক চুল্লীর উপর দিয়ে বাতাস দিয়ে গরম বাতাসেরও ব্যাবস্থা ছিল। পোষাক
পরিবর্তন কক্ষ আর চারপাশ তাকিয়ে স্নানপ্রক্রিয়ার প্রাইভেসি নিয়ে দোটানায় পড়ে
গেছিলাম, পরেই মনে পড়ল এই চারপাশের বড় বড় দালানগুলো তো মরা হাতির পাশে চামচিকা’ই।
তখন তো এর কোন অস্তিত্ব ছিলনা...
তখন ১৬৭৮ সাল। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয়
পুত্র মুহাম্মদ শাহ আজম ঢাকার সুবেদার হিসেবে এই দূর্গের নির্মানকাজ শুরু করেন। তখনকার
দিনে এজকের এই নতুন ঢাকা ছিল শুধুমাত্র শ্বাপদের আস্তানা মাত্র, ঘন জঙ্গল আর বড়
গভীর ডোবাপুর্ন, এদিকটায় বসতিও তেমনকিছু ছিলনা। সেদিক দিয়ে বুড়িগঙ্গা ছিল স্রোতস্বিনী,
উদ্ভিন্নযৌবনা এক নদী যার প্রশ্রয়ে এর তীর ঘেষে ঢাকার পত্তন হয়। কেল্লার পায়ে তখন
বুড়িগঙ্গার ঢেউ নূপুর হয়ে বাজে। মুঘল স্থাপত্যরীতির আদলেই গড়ে উঠতে থাকে “কেল্লা
আওরঙ্গবাদ”; তখনকার সময়ে এই জায়গাটার নাম “আওরঙ্গবাদ” ছিল পরে ইসলাম খা’র শাসনামলে
জায়গার নাম বলদে “ইসলামবাগ” হয়ে যায় (যা আজো “ইসলামবাগ” হয়েই আছে) আর কেল্লার নাম
হয়...। ।
দূর্গের কাজ শুরু হয়ে কেবল মসজিদ ও দরবার হল
নির্মান শেষ হয়, (যে মসজিদে আজো মুসল্লিরা নিয়ম করে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়
করেন) আর এরই মধ্য মারাঠাদের যন্ত্রণায় আতিষ্ট মুঘল সম্রাট পুত্র শাহ আজমকে
বিদ্রোহ দমনে দিল্লি ডেকে পাঠান। ঢাকার ঐশ্বর্যের মোহে পড়া শাহ আজম বুড়িগঙ্গায়
জাহাজে ওঠেন আর পেছনে পড়ে থাকে আসমাপ্ত “কেল্লা আওরঙ্গবাদ”!
এরপর বাংলা শাসনে আসেন বিখ্যাত শায়েস্তা খাঁ, তার
আমলে “টাকায় আট মন” চাল পাওয়া যেত। সেটা ১৬৮০ সালের কথা। তিনি নাকি কেল্লা’র কোন এক
দরজায় এই বলে তালা মেরে যান যেঃ “কেউ যদি আমার পরে এর চেয়ে কম দামে বাঙ্গালিকে
খাওয়াতে পারে সে যেন দরজাটি খোলে”। বলা বাহুল্য তেমন কেউ আর ইতিহাসে আসেনি আর
আসবেওনা আর সেই না-জানা কক্ষের দরজাটিও চিরিদিনের জন্য বন্ধ থেকে হারিয়ে গেছে!
শায়েস্তা খাঁ এরপর আবার দূর্গের নির্মাণকাজে হাত দিলেন। শায়েস্তা খা’এর প্রতি শাহজাদা
আযমের আনুরোধও ছিল দূর্গের কাজ সমাপ্ত করার।
কিন্তু মানুষ চায় এক আর হয় আরেক! এ দূর্গের
ভাগ্যে যেন শেষ লেখা নেই, প্রিয় কণ্যা “ইরান দুখত” বা “রহমত বানু”, পরিবিবি নামেই যিনি
ইতিহাসে পরিচিত এবং যার বিবাহের কথা ছিল এই দূর্গের গোড়াপত্তনকারী শাহজাদা মুহম্মদ
আযম শাহ’এর সাথে; সেই পরীর মত কন্যার মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল পিতা দরবার হল বরাবর নির্মাণ
করলেন কন্যার সমাধিক্ষেত্র। যেন দরবার হলের দরবারে বসে রাজকাজ পরিচালনার সবটুকু
সময়ে কন্যাকে চোখের সামনে পাওয়া যায় আর মসজিদে যাবার পথেই পড়ত সমাধিটি। পরিবিবির
সমাধিক্ষেত্রের জন্য দূর দুরান্ত থেকে মহামূল্যবান পাথর আনা হয়, সুদূর
রাজমহল থেকে এনেছিলেন কালো ব্যাসল্ট পাথর। সাদা মার্বেল পাথরের বড় বড় ফলক এনেছিলেন
জয়পুর থেকে। শ্বেত চন্দন কাঠ এনেছিলেন দরজা ও খিলান নির্মাণের জন্য। সমাধির
ফলকগুলো রাখা হয় আস্ত। তার ওপর কাটা হয় নকশা। সমাধি সৌধের বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করা
হয় ফুলেল নকশাখচিত জালি ও ফলক দিয়ে। এটিই বাংলাদেশের
মুঘল স্থাপত্যের একমাত্র নিদর্শন যেখানে পুরো সমাধিতেই মার্বেল পাথর ও ছাদে কষ্টি
পাথর ব্যাবহার করা হয়েছে। আর এর ভেতরের নয়টি কক্ষ সাজানো চাকচিক্যময় বিভিন্ন রঙয়ের
ফুল পাতার টালি দিয়ে যা দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য স্থাপতে বিরল। বলা হয়ে থাকে এর পুরো
গম্বুজ এমনভাবেই সোনা দিয়ে ছাওয়া হয় যা রৌদ্রকরোজ্জল দিনে চারপাশে এক আশর্য দ্যুতি
ছড়াত। তবে কালের যাত্রায় সেই সোনার পাতের বদলে যায় তামার পাতের আস্তরণে এখনও হয়ত
তার কিছু অবশিষ্ট আছে তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে পরিবিবির মরদেহ আর এখন সমাধিক্ষেত্রে
নেই বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা!
কন্যার মৃত্যুশোক আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি শায়েস্তা
খাঁ, কথিত আছে তিনি দূর্গকে ‘অপয়া’ ভাবতেন তবে এরপর তিনি আর দূর্গের কোন কাজে হাত
দেননি। ১৬৮৮ সালে আগ্রা চলে যাবার পর নির্মাণকাজ শেষ হওয়া আবারও আনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
১৭০৪ সালে বাংলার শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে দুর্গ
হিসেবে লালবাগের রাজনৈতিক গুরুত্ব
কমে যায়। এটি ব্যাবহৃত হতে থাকে
সৈনিকদের ব্যারাক হিসেবে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও এখানকার সব বাঙ্গালী সৈনিকেরা
গর্জে ওঠে কিন্তু সেনাপতি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর “(নামটি মনে করতে পারছি না)” ও বৃটিষ
বেনিয়ার সাথে সেদিন পেরে ওঠেনি বাংলার বিদ্রোহ। সৈনিকে রক্তে লাল হয় লালবাগ, লাল
হয় বুড়িগঙ্গার পানি। এ যেন দূর্গের লালবাগ দূর্গের লাল’এর এর অনন্য মহিমা এনে দেয়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে লালবাগ কেল্লা ব্যাবহৃত হয়েছে
সেনানিবাস হিসেবে। ব্রিটিশরা একে প্রায় ১০০ বছর ব্যাবহার করেছে আর দিন দিন এর
অবস্থা আরো করুণ থেকে করুণতর হয়েছে। আশেপাশে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ অট্টালিকা যা
কেল্লার সৌন্দর্য্যকে নষ্ট করে।
১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন
কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালের
ফেব্রুয়ারী মাসে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে পত্নতত্ব
বিভাগের অধীনে আনা হয়।
অবশেষে নির্মাণের প্রায় ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের
যথাসম্ভব সংষ্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং দর্শনার্থীদের জন্য
উন্মুক্ত হয়।
কালের বিবর্তনে সেই নূপুর হয়ে থাকা নদীপাড় দখল
হয়ে চলে গেছে বহুদুর, কথিত যমুনাপাড়ে যাবার সুড়ংপথ বন্ধ হয়েছে চিরদিনের জন্য, কত
না ঐতিহাসিক নিদর্শন “সামান্য ধূলোমাটি” হয়েছে অবহেলায়, কত আসল নিদর্শন ‘আনডিটেক্টেবল
রেপ্লিকা’য় বদলে গেছে তার খবর রাখার মত বাঙ্গাল কই! সংস্কার করতে গিয়ে,
দর্শনার্থী-বান্ধব করতে গিয়ে প্রধান মুঘলী ফটকের উচ্চতা কমে গেছে অনেকটা, সুন্দর
খিলানের অর্ধেকটাই এখন কংক্রিটের নীচে, অপরুপ কারুকাজ সময় আর সংস্কার’এর সাথে পেরে
না উঠে হারিয়ে গেছে চিরদিনের মত, সব ইতিহাস ঢাকা পড়েছে আজ লালবাগের ব্যাস্ততায়,
সরু রাস্তার মতই সরু হয়ে এসেছে আমাদের পেছনে ফিরে তাকাবার চোখ।
এতকিছুর মাঝেও ২০০৩ এ বুয়েটের আর্কিটেকচার
ডিপার্টমেন্ট আর উৎসাহী কিছু লোকের শুরুর জন্যই সরকারী ও বৈশ্বিক নজর বেড়েছে অনেক,
নতুন “লাইট এন্ড সাউন্ড” শো’টা হয়েছে অসাধারণ এক আয়োজন। শব্দ আর আলোর বর্ণিল খেলার
পাশাপাশি সৈয়দ শামসুল হকের স্ক্রীপ্ট, আসাদুজ্জামান নূর আর সুবর্ণা মোস্তাফার
কন্ঠে ইতিহাস যেন উঠে আসে কালের সীমানা ছাপিয়ে চোখের সামনে। (এখানেও কিছু হতাশা
আছে, লাইট শো’তে এতবেশী চারপাশের “লাইট” তাতে সত্যিকারের আমেজ নষ্ট হয়। বস্তুত এখন
লালবাগকে বড়ই বেমানান লাগে ঐ আধুনিক প্রযুক্তির সুউচ্চ অট্টালিকার ব্যস্ত লালবাগে)!
পরিশেষে আমার শুধু মনে হয়ঃ