প্রতিবছর বইমেলা আসলেই নতুন বইয়ের জন্য মনটা কেমন আনন্দে ভরে ওঠে; কয়টা বইইবা কিনতে পারি (কত্ত চমৎকার বই); ভাবতে থাকি কে কে কি কি বই কিনলো আর ওদের কাছ থেকে বইগুলো কবে নিয়ে পড়ে ফেলা যায়! ছোটবেলা থেকেই বাসায় পড়ে পড়ে ধূলো পড়া আব্বার বইগুলো পড়ে ফেলেছিলাম! আমার নজরুল প্রীতি আর বয়সের চেয়ে বেশী গম্ভীর হয়ে থাকার কারণও মনেহয় অই! কিচ্ছু বুঝিনাই কড়ি দিয়ে কিনলাম; পথের দাবী; পৃথিবীর পথে পড়ে ফেলেছিলাম! কী মোটা মোটা বই! ছোটবেলার সেই ধীরগতিতে ওই বই পড়া সম্ভব হয়েছিলো কেবলমাত্র পড়ার একটা "ক্ষুধা" থাকার কারনে! এখনকার শিশু-কিশোর-তরুণ মনগুলো কি সেই ক্ষুধা সেইভাবে অনুভব করে?
অবশ্য এটা খুব খুশির কথা বইমেলায় আসা এত বইয়ের পাঠকের মত যেটা আমি এখনো অনুভব করি সেটা হলো বই পড়ার ইচ্ছা! এখনো আমার মনে হয় রাত দিন চোখমুখ গুজে একটা বই পড়ে ফেলার মত আনন্দের আর কিছু হয়না! যদিও সেই ফুরসত অনেকটাই কমে গেছে, “চলচিত্র” তার অনেকটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একটা “ভালো” বই একটা চলচিত্রের চাইতে শক্তিশালী।
কীভাবে?
এই যে যখন কেউ একটা উপন্যাস পড়ে, তখন সেই উপন্যাসের চলচিত্রায়ণ হতে থাকে পাঠকের মনের ভেতর সে চাক বা না চাক, লেখকের বর্ণানা আর পাঠকের কল্পনার মিশেলে তৈরি হতে থাকে এক একটা চেহারা, একটা বাড়ির উঠান-ঘাস বা একটা ধু ধু বালু-মাঠ বা একটা পাহাড়-বন-সমুদ্র এমনকি একটা মায়াবতী চেহারা, ক্লান্ত বাতাসে উড়ে যাওয়া চুল, ঠোটের কোনের হাসি অথবা ধরা যাক কোন সুদর্শন যুবা যার চাহনিতে তীব্র আত্নবিশ্বাস, চোয়ালে ফুটে ওঠা মনের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা সব স...ব সবকিছু... যা কিছু মানুষকে কল্পনার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার সব রঙ মিশিয়ে সে সেই বইয়ের লেখাগুলোকে দৃশ্যায়ন করে ফেলে। সেখানে সেইই তার সেই নিজের জন্য তৈরি করা সিনেমার সত্যজিৎ!
চাইলেই পাঠক তার মনের মত করে তৈরী করে নিতে পারে সমস্ত খুঁটিনাটি! এবং এই পুরো অসাধারন একটা ব্যাপারের জন্য কি পাঠককে খুব কষ্ট করতে হয়! মোটেই না। বরং যতক্ষণে লেখাগুলো কোন অর্থ বহন করে পাঠকের নিউরণে যায় সেই নিমিষ সময়েই অযুত কোটি শব্দ-রং মিলিয়ে একটা কল্পদৃশ্য মস্তিস্কে তৈরী হয়ে যায়, এবং এই ব্যাপারটাই পাঠককে তার আজান্তেই বইয়ের পরের পাতাতে নিয়ে যায়! এ এক অসাধারণ ব্যাপার! কখনো সে আনন্দে হেসে ওঠে, কখনো চোখের কোনে অশ্রু জমে, কখনো ক্রোধ, ঘৃণা, হাহাকার বা কোন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা! অনুভুতির জগত নিয়ে এত সুন্দর খেলা করার সুযোগ বই পড়া ছাড়া আর কোথায়! আর নিজের অনুভুতির জগতকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য হাজার হাজার বই তো পড়েই আছে!
আমি মনে করতে পারি প্রথম যখন ছোটদের “ডেভিড কপারফিল্ড” পড়ে এক বিকেল কেঁদেছিলাম। (হয়ত পৃথিবীর মানুষ দুঃখবিলাসী বা পৃথিবীর মধুরতম সংগীত, শ্রেষ্ট কবিতা-গান সব বিরহের – এই কারণে কাঁদার বইয়ের কথাই মাথায় আছে) কিন্তু সেই শেষ বিকেলের ছলছল-চোখজল’এর যে অনন্দ তা এখনো আমি অনুভব করতে পারি। শরতের (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) গ্রীষ্ম-বর্ণনা আর চরিত্রের খুঁটিনাটির যে নিখুঁত বিবরণ তা আজো পাঠককে ভাবায়, প্রেমে পড়ে দেবদস হওয়াও যে “একটা কিছু” “হওয়া” তা তো শরৎবাবুই বুঝিয়ে গেলেন। নজরুলের বিদ্রোহী থেকে সুকান্তের ছাড়পত্র- কত শত আবেগের দোলা। আর রবিবাবু একাই যা লিখে গেলেন – বাঙ্গালি তার নিত্যদিনকার সুখ-দুখ-সব অনুভুতিতে সেখানেই আশ্রয় খোঁজে। আর আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, অনুভব করি- প্রকৃতি দেখার চোখ বিভূতিভূষণের যেমন ছিল তেমনটা আর কারো নয়। কেউ যদি প্রকৃতি দেখার জন্য তার মনের হাজারটা চোখ মেলে চাইতে চায় তবে যেন সে বিভূতিভূষন-এর লেখা পড়ে! ছোট ছোট বিষয় নিয়ে যে কি মজা করে ভাবা যায় তা’র জন্য সুকুমার, রহস্যের হাতেখড়ি সত্যজিৎ, যৌবনে জীবনানন্দের “বনলতা” খোঁজা... এভাবে বলতে থাকলে মানিক, সঞ্জীব, সুনীল, শীর্ষেন্দু, শরদিন্দু্, সমরেশ থেকে আমাদের জাফর-হুমায়ূন (এদের নিয়ে বলা শুরু করা যাবেনা, শুরু করলে থামা মুশকিল হয়ে যাবে... বোধকরি আমাদের প্রজন্মটা বই পড়া নতুন করে শিখল এদের জন্য; এহ এ্যা তিন গোয়েন্দা-মাসুদ রানা চলে আসছে...) পর্যন্ত একটা বিরাট গদ্য রচনা হয়ে যাবে কোন উপযুক্ত বয়ান আমি না করতে পারলেও। (চট করে এই এত্তগুলো নাম চলে এসেছে ভাবলে আরো আজস্র মণি-মুক্তার দেখা মিলবে নিঃসন্দেহে)
আগের দিনে মানে এক দশক আগেও লোকে হয়ত তার বাসায় একটা ভালো পরিমাণ বই সাজিয়ে রাখাকে একটা রূচি বা আভিজাত্যের পরিচয় হিসেবে দেখত কিন্তু এখন মনে হয় সেই জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। লোকে তাদের দামি ফ্ল্যাটের দামি জায়গাটা আর কাগজ দিয়ে ভরতে রাজী নয়। দামি দামি শো-পিস বা দামি কোন অডিও ভিজ্যুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট সেই জায়গাটা দখল করছে। মোটকথা বইয়ের দাম লোকের কাছে কমে গেছে। এত সহজেই যখন হাতেই তালুতে সব, চাইলেই একটা ধুন্ধুমার সিনেমা চালিয়ে দেয়া যায়, শুধু চালিয়েই না ফরমায়েশমত যখন তখন থামা-চালুও করা যায় তখন আর কষ্ট করে বই কে পড়ে! কিন্তু বই না পড়ে পড়ে যে আমাদের “বোধ”-এর জগতকে ভোতা করে দিচ্ছি তা কি কেউ ভেবে দেখছি?
তবে বই মানেই তো আর গল্প-উপন্যাস-কবিতা না, ছাত্রের নাহয় বাধ্য হয়ে বইকিছু কিনতে হয়-কাধে কাধে বইতে হয় কিন্তু “চেক-বই” টাইপের বইয়ের কদর তো কিছুমাত্র কমেনাই সেটা আর বলে দেয়া লাগেনা।
সে সব কথা থাক, কি বলতে কি বলে ফেলছি! তবে আমি আমাদের এই প্রজন্মকে শুধু একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, সেই ছোটবেলায় প্রমথ চৌধুরির “বই পড়া” থেকে কিছু যদি নাও শেখা যায়, “বই” পড়ে যা কিছু শেখা যায়, যা কিছু “অর্জিত হয়”(এর চাইতে ভালো বাংলা মাথায় আসছে না) তার কিন্তু কোন বিকল্প নাই। হাজার গান-সিনেমার মাঝে বইয়ের জায়গাটা কিন্তু সবার উপরে, বলতে গেলে শুরুর দিকের ব্যাপার। তাই এই বই ব্যাবসার, ব্যাবসায়ী লেখকের যুগে যদি আমরা আরো একটু বই পড়তে পারি তবে মন্দ হয়না, তাইনা! শত সহস্র সিনেমা গানের মত অক্ষরের বইগুলো কতশত অনুভূতির ঝড় তোলার জন্য বসে আছে, এখন শুধু নেবার অপেক্ষা অর্জনের অপেক্ষা!
আর সেই সাথে আমি আমার শৈশবের সেইসব বন্ধুদের কথা মনে করতে চাই যাদের বইগুলো আমার ছেলেবেলা’কে এত অনন্দময় করেছিল। সেইসাথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আবু সায়ীদ স্যারের কথা বলতে চাই যে সোনার হৃদয়ের মানুষটা হাজারো শিশু-কিশোরের মনকে “আলোকিত” করে তুলছেন! যার জন্য এখন সবাই মিলে একটা আলোকিত বাংলাদেশের অপেক্ষা করতেই পারি!