Sunday, August 18, 2019

বই পর্যালোচনা: জল জোছনা - হুমায়ূন আহমেদ

বইটি অনেক আগের। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত। আগে পড়েছিলাম তবুও আবার পড়ে ভালো লাগলো। তবে "আগে পড়েছিলাম" এটুকু বুঝতে আমাকে শেষদিকে বুড্ডার সাগরেদ ছোটনের এর বদ অভ্যাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে!(কিশোর মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মাঝে শুধু ঐটুকুই মাথায় রেখে দিয়েছে)।

হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো খুব দ্রুত পড়ে ফেলা যায়, এটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

মূল কাহিনী বেশ ছোট। একটি পরিবার দূরে বেড়াতে যাওয়ার সময় আরিচা ফেরি ঘাটের কিছু আগে রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া দুটি শিশুর মৃতদেহ নিয়ে বাইরে থেকে আসা একটি গ্রুপ ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। যেমনটা আসলে হরহামেশাই হচ্ছে এদেশে। তবে ঘটনার সময়কাল এখন থেকে বেশ আগের। তখনকার বাস্তবতা বইটি পড়লে বেশ বোঝা যায়।

এটি একটি রুঢ় বাস্তব গল্প কিন্তু এই  গল্প বুনন করতে গিয়ে ছোট ছোট চরিত্র এসেছে, দুঃখগাথা, প্রেম, সাহস, মায়া এগুলো এসেছে।

চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে এখানে একটি চরিত্র মীরা বা জোছনা; যে কিনা সশরীরে উপস্থিত না থেকেও পুরো গল্পটির বড় স্থান দখল করে আছে! যাদের কাছে আসলে মানুষ বদলে যায় মীরা ছিল তেমন একজন। মীরা জহিরের স্ত্রী, যে বিয়ের কিছুদিন পরেই কোন কারণে মারা যায়। শুধু পেছনে ফেলে যায় জহির, জহির এর বন্ধু মনজুর, মনজুরের  স্ত্রী রেবেকা এবং তাদের কিছু সম্পর্কের টানাপোড়েন। যদিও শেষ দৃশ্যে এসে সব মিটে যায়। বড় বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজেদের গড়ে তোলা ছোট ছোট সমস্যা কাটিয়ে ওঠে।

নিতু এখানে মনজুর দম্পতির একমাত্র আঠারো বছর বয়সী কন্যা। যদিও সে গল্পের নিয়ামক মাত্র এবং এখানে "অপূর্ব রূপবতী"ও নয়! তবে গল্পের প্রথমে কেন রেবেকা মেয়েকে খারাপ দেখাচ্ছে জেনেও সবুজ শাড়ী পড়তে না দিয়ে কমলা শাড়ি পরতে বাধ্য করে সেটি পরিষ্কার হলো না!

তবে যে চমৎকার একটি দৃশ্যের কথা বলা আছে বইটিতে সেটি দেখতে আমারও ইচ্ছে করছে। কোন এক শীতের পরিষ্কার জোছনা রাতে হাজার হাজার পাখি যদি আকাশে এমন করে উড়ে যায় যে সেই পাখির গায়ে পড়ার কারণে জোছনা মাটি ছুঁতে পারছে না! জোছনার ছায়ায়  চারদিক অন্ধকার! জোছনা মেখে মেখে পাখিগুলো উড়ে চলছে... কী অদ্ভুত, অলৌকিক সুন্দর দৃশ্য!

১৮/০৮/২০১৯

Saturday, August 17, 2019

সাম্মি: উট আর উটপাখি

আজ সে উট আর উটপাখির দুটো ছবি পাশাপাশি এনেছে তার বই থেকে, এবার সে মিলাতে পারছে না।
উট আবার পাখি কেমন করে হয়!?

আবার বাবা বলেছি "উট পাখি কিন্তু একটা পাখি যে উড়তে পারে না!"

একেবারে তালগোল পেকে গেল!😘

১৭/০৮/২০১৯

Thursday, August 15, 2019

বই পর্যালোচনা: লিপি - হুমায়ূন আহমেদ

প্রথমে নাম দেখে মনে হয়েছে:
"হুমায়ূন আহমেদ তো তার গল্পের নায়িকাদের নাম এমন রাখেন না"!
পরে বুঝতে পারলাম প্রচ্ছদ দেখে। এখানে অন্য লিপির কথা বলা হচ্ছে।

ছোট একটি গল্প। হুমায়ূন আহমেদ যখন নর্থ ডাকোটায় থাকতেন তখনকার একটি কথা। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকের ঘটনা; যখন তিনি পিএইচডি করছেন এবং থিসিসের কাজে তুমুল ব্যস্ত। এরিখ থমসন নামের একজনের চিঠির সূত্রে তার উদ্ধার করতে চাওয়া এক লিপি বা চিঠি যেটি কিনা তার "অপূর্ব রূপবতী" ও অসাধারণ মেধাবী স্ত্রী কারোলিনা তার জন্য লিখে গেছেন। গেছেন মানে মারা গেছেন।এরপরের গল্প চমৎকার...

১৫/০৮/২০১৯

Wednesday, August 14, 2019

বই পর্যালোচনা: মামলার সাক্ষী ময়না পাখি - শাহাদুজ্জামান

শাহাদুজ্জামানের সাম্প্রতিকতম বই বোধকরি এটিই। তার প্রথম যে বইটি আমি পড়ি সেটি হচ্ছে সবচে আলোচিত "ক্রাচের কর্নেল"। বইটি পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি মনে হয়েছিল সেটি হচ্ছে তার উপমার ব্যাবহার, একটি আলাদা, উদাস করা, অন্য ধরণের বাক্য ছুড়ে দেয়া। এমন বাক্য খুব বেশি হয়না কিন্তু যে কয়টি হয় সেগুলো পাঠককে ভাবায়।

ক্রাচের কর্নেলের সাথে একটি তুলনা করতে চাইছি এই কারণে যে সেই বইটি যতটা সুখপাঠ্য ছিল এই বইটি ততটা নয়। সেই বইটি পড়েই যেমন মনে হয়েছিলো "এই লেখকের সবগুলো বই পড়ে ফেলতে হবে"! কিন্তু এই বইটি পড়ে তার "কয়েকটি বিহ্বল গল্প" এর মতই লাগছে। ঠিক সুখপাঠ্য নয়, সবশ্রেণীর পাঠক এটি পড়বেন না। অবশ্য এই বইয়ের প্রথম গল্পের মত হয়তো আমি "নকল পাঠক", যে কিনা পরিচিত রাস্তা খোঁজে, অপরিচিত রাস্তা বাঁক খুব একটা দেখতে চায়না!

তবে এই যে প্রথম গল্পটি (জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন") যেমন করে লেখা "কয়েকটি বিহ্বল গল্প" এর প্রথম গল্পও যতদূর মনে পড়ে এমন বিষয়েই লেখা: লেখকের গল্প বুননের যুদ্ধ। (লেখক নিজে প্রতিনিয়ত নতুন করে নতুন গল্প বুননের ক্লান্তিকর চেষ্টা করে চলেছেন বলেই মনে হয়!)

এখানে প্রথমটিসহ মোট ১১ টি গল্প রয়েছে। এখানে আরও একটি পর্যালোচনায় আসা যায় যেমন: লেখক বিশ্লেষণধর্মী লেখায় যতটা পারদর্শী ততটা ঠিক "সহজ ভাষায় গল্প বলা"য় নয়। যেটিকে আমার সবচে দুর্লভ মনে হয়। তার ক্রাচের কর্নেল ও একজন কমলালেবু যতটা পড়তে ভালো লেগেছে অন্যগুলো তেমন নয়। তার প্রথমদিককার বই "একজন নৃবিজ্ঞানী ও কয়েকটি হাড়" বইটিও টেনে নিয়ে যাওয়া পাঠক হিসেবে আমার জন্য কষ্টের ছিল; যদিও আমি নিজেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র!

তবে, লেখকের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুন্দর এবং "ভাবনা উদ্রেককারী" যুতসই একটি নামকরণ! এইখানে তিনি শতভাগ সফল। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও সেটি সত্যি। একটি গল্পের নিতান্তই সাদামাটা ঘটনা থেকে উঠে এসেছে এই নাম "মামলার সাক্ষী ময়না পাখি"! তবে, চিত্তাকর্ষক! ( বইয়ের চাইতে বইয়ের লেখকের আলোচনা হয়ে উঠেছে বেশী! যদিও লেখক কে আমরা চিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমেই। তো retrograde study করা যেতেই পারে!)

যদিও প্রতিটি গল্প স্বতন্ত্র ও সুন্দর তবে আগেই বলেছি গল্পগুলোর পাঠক শ্রেণী নির্দিষ্ট। সকল পাঠক এটি সমানভাবে নেবেন না। কিছুটা বিদেশি লেখকের গল্পের মত মনে হচ্ছিল; যেখানে ঘটনার আবহ দিয়ে ঘটনা বোঝানোর চাইতে সরাসরি গভীর বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা আছে।

আমার নিজের বেশি পছন্দ হয়েছে "টুকরো রোদের মত খাম" গল্পটি। বেশ চিত্তাকর্ষক।

এছাড়া বাকিগুলোকে যদি এক লাইনে বলি:
- মৃত্যু সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার : চমৎকার, নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়
- চিন্তাশীল প্রবীণ বানর : নামটা! গল্প সাদামাটা (এছাড়া একটা ভুল মনে হয় আছে! এই গল্পে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে তখন সবাই রেডিও শোনে, টিভি আসেনি এমন একটা সময়। তখন এই দেশে "ওয়েষ্টার্ন ইউনিয়ন" ছিল কি?)
- পৃথিবীতে হয়ত বৃহস্পতিবার : বেশ আধুনিক সময়ের যাতনার গল্প।
- উবার : কেন গল্পের নাম উবার? শেষ দৃশ্যের মানে কি? (আমি হয়ত বুঝিনি)
- অপসৃয়মান তির : তির বানানটি শিখলাম। ভালো সাধারণ গল্প।
- ওয়ান ওয়ে টিকেট : ভালো গল্প, কিছু নিজস্ব সুন্দর ভাবনার কথা আছে।
- লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে : চিরায়ত গল্প, বৈচিত্রের কিছু নেই।
- মামলার সাক্ষী ময়না পাখি: এই গল্পটিও জানা গল্পের মতই লেগেছে যদিও ময়না পাখির রূপক অর্থ গল্পকে আলাদা অর্থ দিয়েছে।
- নাজুক মানুষের সংলাপ: গভীর, ভাবনার খোরাক আছে, বেশ গভীর বোধ থেকে লেখা কিন্তু বইয়ের শেষ গল্প হিসেব অন্য কিছু চাইতাম।

এইবেলা রাখি। ধন্যবাদ।

১৪/০৮/২০১৯

Friday, August 9, 2019

বই পর্যালোচনা: মাতাল হওয়া - হুমায়ূন আহমেদ

মাতাল হওয়া বইটা আগে পড়া হয়নাই। এতদিন পর পড়লাম এমন একটা সুন্দর বই! মন খারাপ লাগছে!

বইটাতে হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের ছাত্রজীবনের গল্প বলার পাশাপাশি মিলিয়ে আরো একটি গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। সেই গল্পের নায়িকা নাদিয়া, দিয়া বা তোজল্লি!
এই নাদিয়া তার কাছে চিঠি লেখা সত্যিকারের শ্যামলা, ছিপছিপে, ঢাকা ভার্সিটি পড়ুয়া নাদিয়া হতে পারে আবার নাও হতে পারে! গল্পকার মাত্রই গল্প লেখেন, সত্য বয়ান  পাঠক পড়ে না!

এই বইতে হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইয়ের মত নায়িকাকে একবারও "অপূর্ব রূপবতী" বলা হয়নি বরং নায়ককে "গ্রীক দেবতাদের মত", "এমন সুন্দর পুরুষ দেখিনাই", "অপূর্ব রূপবান" ইত্যাদি বিশেষণ দেয়া হয়েছে একাধিকবার। গল্প যার নাম "রাজা চৌধুরী"।

গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে বলা যায় দুদে উকিল, মোনায়েম খাঁর ছোট ভাই ময়মনসিংহবাসী হাবিব সাহেব, যার ডাক নাম "হাবু"। তবে এই ডাকনাম পড়ে তাকে মোটেই জেনতেন ভাববার কোন কারণ নাই। যেকোন কেইসকে নিজের পক্ষে নেবার ক্ষমতা তার আছে, তিনি চাইলে খুনের আসামীকেও ছাড়িয়ে আনতে পারেন, একজনের খুনের দায়ে অন্যকে সাজার ব্যাবস্থা করতে পারেন, পুলিশ আদালত তার হাতের তালুতে। শুধু তার মায়ের কাছে তিনি হাবু!

হাবিব সাহেবের মা, হাজেরা। যিনি সারাক্ষনই তার ঘরে থাকেন এবং সবাইকে তার ইচ্ছামত হুকুম করেন। তার নিজের একটা আলাদা জগৎ আছে, নিজের চিন্তার জগতে তিনি স্বতন্ত্র। অসম্ভব বুদ্ধিমান একজন নারী। তবে তার ছেলে হাবিবের সাথে তার একটা চারত্রিক দ্বিমুখীতা আছে যদিও হাবিব নিজে যতই ধূর্ত হোক, যতই নিয়মের বাইরে যাক মায়ের প্রতি তার আচরণ কখনোও বিরূপ নয়। যদিও হাজেরা বিবি তার এই আচরণের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন গল্পের এক পর্যায়ে।

গল্পের নায়ক বিশাল জলমহালের অধিকর্তা পুত্র রাজা চৌধুরি, হাসান রাজা চৌধুরি। যে এখানে খুনের দায়ে পালিয়ে বেড়ানো আসামী আর হাবিবের সাহেবের মক্কেল! যদিও খুব বিকশিত নয় কিন্তু হাসান রাজা চৌধুরি এখানে চরিত্রবান পুরুষের ছবি।

গল্পের শুরুতে ফারুক চরিত্রের একটি সম্ভবনা দেখা দিচ্ছিল। যথেষ্ট সম্ভাবনাময় চরিত্র হলেও সে মূলধারায় আসেনি।

আরো কিছু চরিত্র আছে হাবিবের সহযোগী প্রণব বাবু, পাংখাপুলার রশিদ, নাদিয়ার শিক্ষক বিদ্যুৎ কান্তি দে (যদিও এই চরিত্রের একটি পরিণতি আছে কিন্তু বিকশিত হবার আরো সুযোগ ছিল! মানে, মনে মনে খুব চাইছিলাম)

গল্পের সাথে সাথে হুমায়ুন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে নিয়ে বলেছেন, সে সময়ের রাজনৈতিক পট নিয়ে কিছু কথা বলেছেন, মওলানা ভাষাণী আর শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থানের কথা আছে। যদিও এগুলোর চাইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাটাই বেশী আলোকিত হয়েছে। খোকা, পাচপাত্তুর এর সাথে তার হাত দেখা, ম্যাজিক দেখানো, প্লানচেট, সম্মোহনবিদ্যা, আনিস সাবেতের সাথে প্রথম মিছিলে যাওয়া এগুলোই বেশী উঠে এসেছে।

আরো গুরুত্বপূর্ণ  হচ্ছে হিমুর "রুপা" চরিত্র সৃষ্টির কথা। বন্ধুর হয়ে তার প্রেয়সীর জন্য প্রেমপত্র লিখে দেয়া, যেগুলোকে নিজে নিজেই তার প্রথম সাহিত্যকর্ম বলে স্বীকার করেছেন। লিখতে লিখতে রুপার ছবিও দেখা হয়ে যায়। হয়ত রুপার জন্য লিখতে লিখতে মিষ্টি রুপার জন্য হুমায়ুনের মনে একটা জায়গা তৈরী হয়েছিল। তাই রুপাকে হারিয়ে দিতে যেতে চাননি, অমর করে রেখেছেন তার গল্পের হিমুর সাথে।

গল্পের শেষের দিকে হাসান রাজা চৌধুরির মত একজন আদর্শ চরিত্রের যুবক কেন খুন করতে গেল তার রহস্য যেমন উন্মোচিত হয়েছে তেমনি একেবারে শেষে চূড়ান্ত বিয়োগান্তক সমাপ্তির মাধ্যমে নাদিয়া ও রাজা চৌধুরি চরিত্রদুটিও পরিণত হয়েছে।

পাঠককে ভাবাবার মত একটা সমাপ্তি আছে। একটা হাহাকার আছে, আবার অনেক উত্তর না জানা প্রশ্নও আছে।

সবমিলে চমৎকার একটা বই।

২৭/০৭/২০১৯