মাতাল হওয়া বইটা আগে পড়া হয়নাই। এতদিন পর পড়লাম এমন একটা সুন্দর বই! মন খারাপ লাগছে!
বইটাতে হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের ছাত্রজীবনের গল্প বলার পাশাপাশি মিলিয়ে আরো একটি গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। সেই গল্পের নায়িকা নাদিয়া, দিয়া বা তোজল্লি!
এই নাদিয়া তার কাছে চিঠি লেখা সত্যিকারের শ্যামলা, ছিপছিপে, ঢাকা ভার্সিটি পড়ুয়া নাদিয়া হতে পারে আবার নাও হতে পারে! গল্পকার মাত্রই গল্প লেখেন, সত্য বয়ান পাঠক পড়ে না!
এই বইতে হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইয়ের মত নায়িকাকে একবারও "অপূর্ব রূপবতী" বলা হয়নি বরং নায়ককে "গ্রীক দেবতাদের মত", "এমন সুন্দর পুরুষ দেখিনাই", "অপূর্ব রূপবান" ইত্যাদি বিশেষণ দেয়া হয়েছে একাধিকবার। গল্প যার নাম "রাজা চৌধুরী"।
গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে বলা যায় দুদে উকিল, মোনায়েম খাঁর ছোট ভাই ময়মনসিংহবাসী হাবিব সাহেব, যার ডাক নাম "হাবু"। তবে এই ডাকনাম পড়ে তাকে মোটেই জেনতেন ভাববার কোন কারণ নাই। যেকোন কেইসকে নিজের পক্ষে নেবার ক্ষমতা তার আছে, তিনি চাইলে খুনের আসামীকেও ছাড়িয়ে আনতে পারেন, একজনের খুনের দায়ে অন্যকে সাজার ব্যাবস্থা করতে পারেন, পুলিশ আদালত তার হাতের তালুতে। শুধু তার মায়ের কাছে তিনি হাবু!
হাবিব সাহেবের মা, হাজেরা। যিনি সারাক্ষনই তার ঘরে থাকেন এবং সবাইকে তার ইচ্ছামত হুকুম করেন। তার নিজের একটা আলাদা জগৎ আছে, নিজের চিন্তার জগতে তিনি স্বতন্ত্র। অসম্ভব বুদ্ধিমান একজন নারী। তবে তার ছেলে হাবিবের সাথে তার একটা চারত্রিক দ্বিমুখীতা আছে যদিও হাবিব নিজে যতই ধূর্ত হোক, যতই নিয়মের বাইরে যাক মায়ের প্রতি তার আচরণ কখনোও বিরূপ নয়। যদিও হাজেরা বিবি তার এই আচরণের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন গল্পের এক পর্যায়ে।
গল্পের নায়ক বিশাল জলমহালের অধিকর্তা পুত্র রাজা চৌধুরি, হাসান রাজা চৌধুরি। যে এখানে খুনের দায়ে পালিয়ে বেড়ানো আসামী আর হাবিবের সাহেবের মক্কেল! যদিও খুব বিকশিত নয় কিন্তু হাসান রাজা চৌধুরি এখানে চরিত্রবান পুরুষের ছবি।
গল্পের শুরুতে ফারুক চরিত্রের একটি সম্ভবনা দেখা দিচ্ছিল। যথেষ্ট সম্ভাবনাময় চরিত্র হলেও সে মূলধারায় আসেনি।
আরো কিছু চরিত্র আছে হাবিবের সহযোগী প্রণব বাবু, পাংখাপুলার রশিদ, নাদিয়ার শিক্ষক বিদ্যুৎ কান্তি দে (যদিও এই চরিত্রের একটি পরিণতি আছে কিন্তু বিকশিত হবার আরো সুযোগ ছিল! মানে, মনে মনে খুব চাইছিলাম)
গল্পের সাথে সাথে হুমায়ুন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে নিয়ে বলেছেন, সে সময়ের রাজনৈতিক পট নিয়ে কিছু কথা বলেছেন, মওলানা ভাষাণী আর শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থানের কথা আছে। যদিও এগুলোর চাইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাটাই বেশী আলোকিত হয়েছে। খোকা, পাচপাত্তুর এর সাথে তার হাত দেখা, ম্যাজিক দেখানো, প্লানচেট, সম্মোহনবিদ্যা, আনিস সাবেতের সাথে প্রথম মিছিলে যাওয়া এগুলোই বেশী উঠে এসেছে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হিমুর "রুপা" চরিত্র সৃষ্টির কথা। বন্ধুর হয়ে তার প্রেয়সীর জন্য প্রেমপত্র লিখে দেয়া, যেগুলোকে নিজে নিজেই তার প্রথম সাহিত্যকর্ম বলে স্বীকার করেছেন। লিখতে লিখতে রুপার ছবিও দেখা হয়ে যায়। হয়ত রুপার জন্য লিখতে লিখতে মিষ্টি রুপার জন্য হুমায়ুনের মনে একটা জায়গা তৈরী হয়েছিল। তাই রুপাকে হারিয়ে দিতে যেতে চাননি, অমর করে রেখেছেন তার গল্পের হিমুর সাথে।
গল্পের শেষের দিকে হাসান রাজা চৌধুরির মত একজন আদর্শ চরিত্রের যুবক কেন খুন করতে গেল তার রহস্য যেমন উন্মোচিত হয়েছে তেমনি একেবারে শেষে চূড়ান্ত বিয়োগান্তক সমাপ্তির মাধ্যমে নাদিয়া ও রাজা চৌধুরি চরিত্রদুটিও পরিণত হয়েছে।
পাঠককে ভাবাবার মত একটা সমাপ্তি আছে। একটা হাহাকার আছে, আবার অনেক উত্তর না জানা প্রশ্নও আছে।
সবমিলে চমৎকার একটা বই।
২৭/০৭/২০১৯
No comments:
Post a Comment