Friday, February 3, 2017

বাংলা প্রশ্নপত্রের আবশ্যিক ব্যাবচ্ছেদঃ বাংলা

এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষাটি শুরু হয়েছে বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র দিয়ে।  পরীক্ষার ঠিক পরপরই অন্যসব বিষয়কে ছাপিয়ে উঠে এসেছে প্রশ্নপতত্রের ভাষা।

সর্বাধিক সমালোচিত হয়েছে ২ নং প্রশ্নটি।  যেটি শুরু হয়েছে এভাবে “জাহেদ সাহেব একজন লোভী ডাক্তার। অভাব ও দারিদ্র বিমোচন করতে গিয়ে তিনি সবসময় অর্থের পেছনে ছুটতেন। এক সময় গাড়ি-বাড়ি, ধন-সম্পদ সবকিছুর মালিক হন। তবুও তার চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। অর্থ উপার্জনই তার একমাত্র নেশা। .......”

এখানে সাদামাটা দৃষ্টিতে একজন অভাবী ডাক্তারের দারিদ্রের পেছনে ছুটতে ছুটতে অর্থলোভী হয়ে ওঠার দৃশ্যপট আঁকা হলেও সেটি কি আমাদের সমাজের সহজাত দৃশ্য? আমাদের সমাজে একজন রিক্সাওয়ালা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অর্থ উপার্যন করেন, একজন ট্রাফিক পুলিশ চাঁদা নেন এই দৃশ্যগুলো যত পরিচিত “অর্থলোভী ডাক্তার” কি এতটা সহজাত?

আমি জানি ঠিক আগের লাইনটি পড়ার পরই অনেক পাঠকের মনে “ট্রাফিক পুলিশ”দের জন্য একটি সহানুভূতির জায়গায় আঘাত লেগেছে। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সামান্য বেতনে সারাদিন যারা শব্দ-ধূলোর মাঝে কাজ করেন তাদেরকে এভাবে না বললেই কি নয়!?

ঠিক তাই!

আমাদের সমাজে সব পেশাতেই “মানবিক মূল্যবোধের” অবক্ষয় ঘটেছে। সেটা আপনি পুলিশ, ডাক্তার, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাবসায়ী থেকে শুরু করে মৌলানা পর্যন্ত বিস্তৃত। খোদ শিক্ষকের মাঝেও কি “অসাধু”র সংখ্যা কম? তাই বলে আপনি যখন একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নে এমন করে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে “দুর্নামঃ করে ফেলেন তাতে যে চিকিৎসক সমাজ মারাত্মক আহত হবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। 

যেমনঃ যদি প্রশ্নের লাইনগুলো হত এমনঃ “ জাহেদ সাহেব একজন ঘুষখোর পুলিশ” বা “জাহেদ সাহেব একজন দূর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ” বা “জাহেদ সাহেব একজন লম্পট শিক্ষক”। এ সবগুলো বাক্যই কিন্তু প্রতিটি পেশার মানুষের জন্য চরম অবমাননাকর যা কোনভাবেই “মাধ্যমিকের” প্রশ্নপত্রের ভাষা হতে পারেনা।

২ নং প্রশ্নটা নিয়েই প্রশ্ন
 বেশী উঠেছে কিন্তু সমস্যা আরো আছে...

যেমন ধরুণ; ১ নং প্রশ্নটির ক্ষেত্রে।
প্রশ্নটি এমনঃ “কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছে মাইনুল। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত।  এখানে আদিবসীরা সামুদ্রিক বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে। দোকানীরা বেশিরভাগই যুবতী। তারা দোকান পরিচালনা করছে। তাদের কলহাস্যে মুখরিত দোকানগুলো।  মাইনুল উপলদ্ধি করলো যে কাজের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারী-পুরুষের মাঝে তেমন কোনো ভেদাভেদ নেই”।

পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমিকের প্রথম পরীক্ষার প্রথম প্রশ্নটি সে হাতে পেয়েছে, যেখানে তাকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে (ভালো কথা, পরীক্ষার প্রথমেই একটু রিলাক্সেশন) এরপর সেখানে চট করেই "যুবতী" দের নিয়ে আসা হয়েছে। খুব খেয়াল করে দেখতে হবে! শব্দটি তরুণী বা মহিলা বা স্ত্রীলোক নয়, "যুবতী"!
আসুন এই বিশেষ শব্দটির বাংলা ভাষায় ব্যাবহার দেখি।

বাংলা ভাষায় কিন্তু "সমার্থক শব্দ" বলে একটা বিষয় আছে,
 যেমন: কন্যা শব্দের সমার্থক শব্দ হতে পারে মেয়ে, নন্দিনী, কুমারী, ঝি, বেটি, দুহিতা, ভাযা, দুলালী, আত্মজা, নন্দিনী, পুত্রী, সূতা, তনয়া ইত্যাদি
তো আমরা যদি কাউকে নিজের মেয়েকে পরিচয় করিয়ে বলি? “ আমার মেয়ে” বা “আমার ভাযা” বা “আমার ঝি”, সবগুলোর অর্থ কি এক দাঁড়ায়? দাঁড়ায় না।

আবার এভাবে তরুণী শব্দটিরও প্রতিশব্দ হতে পারে ললনা, রমণী, মহিলা, স্ত্রী, মেয়ে, কামিনী, মহিলা, স্ত্রীলোক, অঙ্গনা, ভাসিনী, কান্তা, সীমন্তনী, অওরত, অঙ্গনা, কলত্র, জানি, জায়া, জেনানা, বধূ, বামা, ভার্যা ইত্যাদি
তবে খেয়াল করে দেখুন এখানে “যুবতী” কিন্তু নেই। যুবতী শব্দটি আসলে ঠিক তরুনীর সমার্থক নয়। যুবতী শব্দটি “যৌবন” এর সাথে 
যতটা জড়িত ততটা কিন্তু অন্য শব্দগুলো নয়। আমরা কিছু কিছু শব্দ ব্যাবহার করতে করতে তার একটা আলাদা মানে তৈরী হয়েছে। আমরা “তরুণী” বললে যা বুঝি “মহিলা” বললে কিন্তু ঠিক সেটা বুঝিনা, আবার “কামিনী” বা “স্ত্রীলোক” এগুলোরও কিন্তু আলাদা করে মানে দাঁড়ায়।  

বাংলা সাহিত্যেও শব্দগুলোর আলাদা আলাদা ব্যবহার আছে। তাই মাধ্যমিকের প্রশ্নে কোনভাবেই শব্দটি “যুবতী” হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, সেটা 
তরুণীও হতে পারতো।  আদিবাসীরা তো আর সমুদ্র সৈকতে “যৌবনের” পসরা নিয়ে বসেনি, বসেছে সামুদ্রিক জিনিস নিয়ে!
“তাদের কলহাস্যে মখুরিত” বাক্যটিও “যুবতী” শব্দটি ব্যাবহারের পর ঠিক অতটা নিষ্কলুষ থাকেনা, যদি “তরুণীরা কলহাস্য” করে আর “যুবতীরা কলহাস্য” করে তার মানে কি এক দাঁড়ায়।  আমরা নাহয় ধরেই নিলাম সৈকতের দোকানীরা খুব “হাসিখুশি” থাকে!

আবার ২ নং প্রশ্নের দৃশ্যপটের পর ৪ নং প্রশ্নের “রহিম চৌধুরী কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কিছুদিন পূর্বে তাঁর বড় মেয়ের বিয়েতে এলাকার সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ধনী-গরীবের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। তাঁর এ আচরণে এলাকার দরিদ্র জনগণ খুবই সন্তষ্ট”।

এখানে আসলেই খুবই সুন্দর কথা বলা হয়েছে। রহিম সাহেবকে বারবার “তাঁর” (চন্দ্রবিন্দু সহ তার) বলে সম্বোধন করা হয়েছে, তাকে সম্মান দেয়ার ব্যাপারে প্রশ্নকর্তা কোন কার্পণ্য করেননি।  কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের “মালিক” রহিম সাহেবেরা যদিও সচরাচর “সাধারণ” জীবনযাপন করেন না বা “এলাকার সকলকে দাওয়াত দেয়া” সাধারণ জীবনযাপনের সাথে ঠিক যায় কিনা প্রশ্ন থেকে যায় (যেহেতু পত্র পত্রিকায় ৮০ মণ গরু আর ২০ মণ খাশি খাওয়ানোর খবরগুলো তো আর আমরা ইতিবাচকভাবে নিইনা) তথাপি এই দৃশ্যপট প্রশংসনীয়। এটি থেকে হয়ত শিক্ষার্থীরা কিছু অনুপ্রেরণা পাবে, ধনী হলেও তারা গরীবদের কথা ভউলে যাবেনা।

কিছুদিন আগেও প্রাইমারীর পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যে কেলেংকারী দেশবাসী দেখেছে এবং এই প্রশ্নপত্র দেখার পর আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থা ও এর সাথে জড়িতদের নিয়ে আরো যৌক্তিক ও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।  আমাদের শিশুদের আমরা কি শেখাচ্ছি? আমাদের কিশোরদের আমরা কি ধারণা দিতে চাইছি? সৃজনশীল প্রশ্নপত্র নিয়ে আমাদের যে অসীম আশা ছিল সেটির পেছনে কোন অশুভ তৎপরতা চলছে নাতো!?

একটি দেশেকে এগিয়ে যেতে হলে সে দেশের শিশুদের সঠিক শিক্ষাটা যেমন দিতে হয়, সে দেশের কিশোর ও তরুণদের তেমনি সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হয়।  একটি নির্দিষ্ট পেশা বা গোষ্ঠী বা শ্রেণীকে হেয় করে জাতি হিসেবে বড় হওয়া যায়না এই শিক্ষাটাও ধারণ করতে হয়।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী আমাদের জন্য অনেক করবার চেষ্টা করেছেন, তিনি অত্যন্ত কর্মঠ ও বিজ্ঞজন। আমরা চাই তিনি এই বিষয়গুলোকে আরো গুরুত্ব দিন। সমস্যাকে প্রথমে “সমস্যা” বলে স্বীকার করুণ নইলে আমাদের সমানের দিনগুলো নিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলো বড় ফিকে হয়ে আসে।
  

No comments:

Post a Comment