Tuesday, January 22, 2019

পরাবাস্তব জগৎ

আজ নিয়ে প্রায় টানা ৫ টা নাইট ডিউটি করলাম। জেনারেল সার্জারি আর প্লাস্টিক সার্জারীর নন এডমিশন - এডমিশান সব মিলিয়ে এই অবস্থা! নিজের রোস্টার ছিল সাথে অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে এবং পুরনো ডিউটি নিজ থেকে ফেরত দিতে গিয়ে সংখ্যা বেড়ে গেল!

গতকাল রাতে এডমিশান ডিউটি করে বাসায় ঘুম ভালো হয়নি, একটু কাজ গোছানোর চেষ্টা করেছি। গত কয়েকদিনের নাইট ডিউটি করার কারণে একটা স্লীপ দেট (Sleep Debt) ছিল। তাই আজকে শরীরটা ছিল ক্লান্ত।

পর পর মঙ্গল আর রবিবার দুটো অ্যাডমিশন হওয়ায় এবং শীতকাল হওয়ায় অসংখ্য রোগী ভর্তি হয়ে একেবারে কানায় কানায় ভরে আছে প্রতিটি ওয়ার্ড, ওয়ার্ডের বারান্দা! পুরুষ ওয়ার্ডের মেঝে খালি ছিল কিছুটা এছাড়া মহিলা, শিশু ওয়ার্ড আর এগুলোর HDU আমাদের ব্লু ইউনিটের রোগী দিয়েই ভরে গেছে! আইসিইউ তেই আমাদের রোগী মোট সংখ্যার ৮০ ভাগ!

পুরুষ, মহিলা, শিশু সব ওয়ার্ডেই  ধারণক্ষমতা  চাইতে  অনেক বেশি রোগী ছিল। একজন ভিআইপি রোগী আছেন আইসিইউতে, সংরক্ষিত নারী আসনের পদপ্রার্থীর মা! তাকে বিকালে দেখে গিয়েছেন নসরুল হামিদ বিপু! এই অতিরিক্ত ঝামেলার কারণে সাধরণ রোগিগুলোকেও সেভাবে দেখা যাচ্ছিল না।

বারবার আইসিইউতে যেতে হয়েছে, শুধু পুরুষ ওয়ার্ড ছাড়া সবগুলো জায়গায় রোগীতে ভরপুর! আক্ষরিক অর্থেই কোন রোগীর পাশে যেতে হলে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল, যায়গা যাওয়া যাচ্ছিল না! এমনিতেই কয়েকদিনের টানা ডিউটি করে স্লিপ ডেট রয়ে গেছিল তাই সেভাবে মনযোগ ধরে রাখা যাচ্ছিল না। রাতের একসময় মনে হচ্ছিল  একটা পরাবাস্তব দুনিয়ার আছি। আমি আমাকে চালাচ্ছি না! আইসিইউ থেকে এক রোগীর স্বজন এসে আবদার করল তার রোগীকে দেখতে যেতে হবে তখন আমি ঠিক মাথা সোজা করে রাখতে পারছিনা, মনে হচ্ছিল কেউ আমার মাথা ধরে রাখলে খুব ভাল হত! কিন্তু আমি সেই রোগীকে দেখে এসেছি এবং আমি জানি ওনার জন্য খুব বেশী কিছু করার নাই আমার তবে আমার একবার দেখতে যাওয়া উচিত নইলে রোগীর স্বজনের কাছে চিকিৎসা গ্রহনযোগ্য মনে হবে না। কিন্তু এভাবে যদি সবার রোগী দেখতে যেতে হয় তবে ডাক্তার লাগবে কয়েকজন! তাও কিছুক্ষণ বসে একটু স্থির হয়ে দেখে এলাম। এরপর একটু শোয়ার পরেই আসল এক মওলানা যার বাচ্চাকে আমি দেখে এসেছি এবং ভালোভাবেই সব বলে এসেছি। কিন্তু ভালোভাবে বলআর একটা ঝামেলা হল, লোকজন তখন যা তা সব আবদার করে বসে এবং সেগুলো মেটানো কোন চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব না! তখন মনে হল বাঙালি হিসেবে আমরা কিছুটা "ঝাড়ি প্রিয়"! যে আমাকে শাসন করতে পারে, শাসনের সুরে কথা বলে আমরা তাকে বেশী মূল্যায়ণ করি এবং তার কথা মনযোগ দিয়ে শুনি। চিকিৎসা করার সময় এই জাহড়ি বেশ কাজে দেয়!

এসব করতে করতে একসময় ভোরের দিকে একটা বাচ্চা মারা গেল আসমা, ১২ বছরের প্রতিবন্ধী। এরপর শুরু হল তার মায়ের আহাজারি! একটানা বিলাপ করতে থাকা!

হঠাত একটা ঘোরলাগা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বলে মনে হতে লাগলো। মনে হচ্ছিল হয়ত এই জীবন আমার নয়, এই মুহুর্ত আমার না, আমি যা করছি তা ঠিক আমি করছি না, কেউ আমাকে দিয়ে এগুলো করিয়ে নিচ্ছে! একটা পরাবাস্তব জগতে ঢুকে গেছি বলে মনে হচ্ছিল!

১৮.০১.২০১৯

No comments:

Post a Comment