বইয়ের শুরুতে যেভাবে দুলাইন লেখা:
"যদ্যপি আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়,
তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়!"
তাতে মনে হয়েছিলো বুঝি বেশ রসের দেখা পাওয়া যাবে বইটিতে। কিন্তু অবস্থা মোটেই তা না, বেশ সিরিয়াস টাইপ লেখা যার বিষয়বস্তু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক; লেখকের শিক্ষক, যাকে তিনি "গুরু" মেনেছেন।
যদিও সত্য কথন হচ্ছে আমি ওনার নামই এর আগে শুনিনাই!(অবশ্য আহমদ ছফাও তার সময়ে তার নিজের প্রয়োজনের আগে প্রফেসর রাজ্জাককে চিনতেন না!) তবে পুরো বই পড়ে কিন্তু আমার প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি একটা আলাদা শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে।
খুব ঋজু চরিত্রের অধিকারী, স্পষ্টভাষী, বিলাসহীন ও প্রচারবিমুখ, আজীবন অকৃতদার এবং সবাইকে উপেক্ষা করে নিজের মতে অবিচল থাকার মত দৃঢ় এই মানুষটির নেশা বলতে হুক্কা, আর সত্যিকারের নেশা হচ্ছে বই পড়া! ক্লাস নিতে তাকে খুব বেশি আগ্রহী মনে হয়নি কিন্তু পড়াশোনায় তার আগ্রহ অসীম। তার পান্ডিত্য সবাইকে চুম্বকের মত আকর্ষন করত। অনেকেই ঈর্ষা-কাতর হতেন তার জ্ঞানের জন্য। শুধু তার সময়ের না, যে কোন সময়ের জন্যেই হয়ত তিনি অনন্য বিদ্বান একজন মানুষ। এমনকি শেষদিকে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে জ্বরাগ্রস্ত হলেও তাকে দেখা গেছে ঝুঁকে বইয়ের পাতায় ডুবে যেতে।
লেখকের সাথে তার দেখা বা পরিচয় হয় মাষ্টার্সের আগেই পিএইচডি স্কলারশীপের থিসিসের সুপারভাইজার খোজার সুবাদে। বাংলা সাহিত্যের ওপর করা এই থিসিস যদিও শেষতক আলোর মুখ দেখেনি (কাকতালীয়ভাবে তার সুপারভাইজার প্রফেসর রাজ্জাকের থিসিসটিও কখনও আলোর মুখ দেখেনি!)। স্বাধীনতার আগে শুরু করা পিএইচডি ডিগ্রিটাও তার নেয়া হয়নি কিন্তু পরিচয়টা রয়ে গেছে, বাহাত্তর থেকে চুরাশি; তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডালপালা মেলেছে; অবলীলায় ঢাকাইয়া বুলি আওড়ানো প্রফেসর রাজ্জার ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছেন আহমেদ ছফা'র গুরুতে। (আহমদ ছফার মত বিদগ্ধজনের গুরুর আসন নেয়া কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! যেখানে আধুনিক যুগের অনেক প্রতিথযশা লোকের কাছেই ছফা একজন আদর্শ!)
বইয়ের প্রথম যে কথায় আমার টনক "বড়সড় আকারে" নড়ে সেইটা হচ্ছে, প্রফেসর রাজ্জাকের মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও জ্ঞান তৈরিতে উল্ল্যেখ্য তেমন অবদান নেই! প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত তৈরী, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই তিনটি বড় অবদান ছাড়া আর বলবার মত কিছু নেই! যদিও এই তিনটিই পুরো জাতিকে পথ দেখিয়েছে তবুও জ্ঞানচর্চা ও বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তেমন ভূমিকা রাখেনি। জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কোন গবেষণা করার চেষ্টা করেন নি; শুধু মিলাদ আর বিয়ে পড়ানোয় সময় পার করেছেন; ইংলন্ডের ডিক উইলসন, ফ্রান্সের ক্লদ লেভি লস-সহ দেশী অংকের রমজান আলী(যার বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ হবার সকল সম্ভবনা ছিল); অনেক বিখ্যাত জ্ঞানীগুনীজন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপনা করেছেন কিন্তু তারাও একে শিক্ষায় "আদর্শ" করতে পারেন নি। "প্রাচ্যের অক্সফোর্ড" সর্ববেই একটি "অতিশয় রঞ্জিত" কথা! (ভাববার বিষয়!!)
কোন একটা জায়গাকে চেনার উপায় হচ্ছে সেখানকার বাজার আর বইয়ের দোকানে যাওয়া! সেখানকার মানুষ কি খায় আর কি পড়ে তা দিয়েই তাদের যাচাই করা যায়। পুরোন ঢাকার মানুষ হিসেবে ছিলেন ভোজনরসিক(তবে তার লেখায় বাকরখানির কথা থাকলেও বিন্দুমাত্র কাচ্চির কথা নেই!) এবং যে দেশে যেতেন সেখানকার অন্তত একটা রান্না শিখে আসতেন।
প্রফেসর রাজ্জাকের শিল্পকলা বোধও খুব তীক্ষ্ণ! তিনি বলেন শিল্পাচার্য জয়নুলের মত স্পেসের ব্যবহার আর কোন শিল্পী এত নিখুঁতভাবে করতে পারেনি; দুজন পালকি বাহকের মাঝে যে সুন্দর দূরত্ব থাকার কথা সেটাও তার ছবিতে আছে! ছবিতে খালি যায়গা রাখাও যে একটা মুন্সিয়ানা সেটা জয়নুল দেখিয়েছেন। এসব থেকেই বোঝা যায় প্রফসর সাহেবের বোধের জায়গাটা কত গভীর। পরে আহমদ ছফার চেষ্টায় এস এম সুলতান প্রফেসর রাজ্জাকের নজরে আসেন পক্ষান্তরে দেশবাসী এস এম সুলতানকে আবিষ্কার করে। যদিও এখানে লেখকের ভূমিকার কথা লেখক সন্তর্পনে এড়িয়ে গেলেও সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝবেন এই গুণী শিল্পী হয়ত সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতেন লেখকের চেষ্টাটুকু না থাকলে। গানের বেলাতেও তার নজরুল প্রীতি লক্ষ্য করবার মত। শিল্পী আব্দুল করিমকে তিনি অনন্য সুরের আধিকারী বলেছেন। সামান্য মৃৎশিল্পীর মাঝে তিনি ভাষ্করকে আবিষ্কার করেছিলেন।
তার অবসর কাটত একমাত্র দাবা খেলায়। বাংলাদেশের প্রথম গ্রান্ড মাষ্টার দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদকেও প্রশিক্ষণ ও পারিবারিক সাহায্য দিয়েছেন এই প্রফেসর।
তার পরিচয়ের বলয়টাও ঈর্ষা করবার মত। নিজে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন প্রখ্যাত অর্থনিতিবিদ হ্যারল্ড লাস্কির তত্ত্বাবধানে! যার কাছে নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তাকে বিকোতে হবে বলে পিএইচডি শেষ না করেই থিসিস পেপার নিয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। অবশ্য এই সূত্র ধরে কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের একটা "সহজ সূত্র" পাওয়া যায়ঃ "যা কিছু সামনে আসে গোগ্রাসে পড়তে হবে, কিছুদূর যাবার পর আপনাতেই বোঝা যাবে কোনদিকে এগুতে হবে"।
এছাড়া চমকিত হই যখন স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে খুব স্বল্প সময়ের সফরে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং বাংলাদেশ সরকার উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কিসিঞ্জারকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন করে। সেখানে সুযোগ পান মলিন পোষাকের প্রফেসর রাজ্জাক যাকে কিসিঞ্জার নিজের স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন "সহকর্মী" হিসেবে! যদিও মাত্র দু-ঘন্টার সফরের আধ ঘন্টাই যখন রাজ্জাক সাহেব নিয়ে নেন তখন সরকারের একটু নড়ে চড়ে বসতে হয় বৈকি! এমনকি ডিক উইলসনের লেখা বই "এশিয়া আ্যওয়েকস" (যেটাকে গুনার মিরডালের নোবেল পাওয়া বই এশিয়ান ড্রামার সমকক্ষ ধরা হয়) বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখা "টু আব্দুর রাজ্জাক অব ঢাকা"!
ইতিহাস নিয়ে তার জ্ঞান কিছু কথাতেই স্পষ্ট হয়ঃ "আপনারা রামমোহনরে একেবারে আকাশে তুইলা ফেলাইছেন, রামমোহন বিলেতে যাবার সময় তাকে 'রাজা' টাইটেল দিলেন বাহাদুর শাহ যার নিজেরই কোন রাজত্ব আছিল না। কিন্তু রামমোহন সেইটা সারাজীবন আগলাইয়া রাখলেন!" যদিও বাংলা ভাষার গৌড়িয় ব্যকরণের কাজ করাকে রামমোহনের অনন্য কাজ হিসেবে বলেছেন তিনি। উর্দু, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত অনেক ভাষাতেই কাজ করার সুযোগ থাকলেও বাংলাকে বেছে নেয়াই রামমোহন অনন্যতা। তবে তিনি নব্বইয়ের দশকের সত্যিকারের "বড় মানুষ" হিসেবে বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি বলেছেন "ইতিহাস ওনাকে স্টেটসম্যান হইবার সুযোগ দিছিল"! এখানে অবশ্য গভীর ভাবনার অবকাশ আছে, কারণ নানা কথায় পরবর্তীকালে তাকে জিন্নাহর সমর্থনে দেখা যায়। তার "পাকিস্তান" সমর্থনের পেছনে যে কারণ লেখক দেখিয়েছেন তা লেখকের নিজেরই মনঃপুত না হলেও সেখানে চিন্তার খোরাক মেলে, গভীর চিন্তার খোরাক!
এই জ্ঞানী মানুষটিকে নিয়ে খুশবন্ত সিংয়ের ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াতে প্রধান প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। যিনি পরে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডী-লিট পান।
ফজলুল হকের সাথে সাক্ষাতে একবার তিনি সরাসরিই বলেছিলেন "আপনি খুব সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য মিছা কথা কইবার পারেন"! ফজলুল হকের ওপর গবেষনার কাজেই রাজ্জাক সাহেবের কাছে এসেছিলেন মিসেস কামাল হোসেন; হামিদা। বস্তুত প্রফেসর রাজ্জাকের বাসাতেই তাদের পরিচয় ও পরবর্তিতে বিবাহ, কারণ তিনি দুজনকেই বিশেষ স্নেহ করতেন।
এভাবেই নানা মানুষ তার সহচার্যে এসেছেন, নিজেদের স্বার্থে বা প্রয়োজনে। কাউকেই তিনি ফিরিয়ে দেননি। এমনকি তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে লেখা বইয়ের লেখকও যখন তার কাছে বিদেশী স্কলারশীপ পাবার জন্য রিকমেন্ডেশন চায়, তিনি অবলীলায় তা করে দেন। বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় এভাবেই এক জ্ঞানী ও মহৎ চরিত্রের প্রফেসর রাজ্জাককে খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও নোট রাখা বা টুকে রাখার অভ্যাস না থাকায় এই বইটি যে লেখকের নিজের মতামতের মিশ্রণ না- তা বলা যায়না তথাপি একজন অসম্ভব জ্ঞানী মানুষের দেখা মেলে। যিনি নিজে কিছু লিখে জাননি বলে হয়ত তার জ্ঞানটুকু বা পরিচয়টুকু আমরা খুব একটা পাই না। কিন্তু তিনি কেন তেমন কিছুই লেখেন নি তার একটা আহমদ ছফা ব্যাখ্যা বেশ আগ্রহউদ্দীপকঃ তিনি তার সমকালীন সকলের চাইতে এতটাই বেশী জ্ঞানী ছিলেন যে তার লেখা তখনকার লোকে ঠিক নিতেই পারত না, তার লেখার গভীরতা বুঝবার মত পাঠকশ্রেণীর অভাবেই মূলত তিনি লেখেন নি!!!
এই শেষ কথাটুকুই কিন্তু তাকে আরো রহস্যময় করে তোলে!
১৪/১০/২০১৮