Tuesday, June 11, 2019

সাম্মির গল্প

- মা! শোন তোমাকে একটা গল্প বলি!
- ঠিক আছে! বলো!

- একটা দেশে একটা বানর ছিল। সে খুব দু:খিত ছিল।
- দু:খিত ছিল কেন? ওর কি দু:খ ছিল? (দু:খিত মানে দুখি ছিল! 😁)
- ঐ যে! বানরাটা যে পান্তা পছন্দ করত!
- তারপর?
- ও খুব পান্তা পছন্দ করত আর ও খুব দু:খিত ছিল।
- তারপর?
- ওর একটা কাকা ছিল, তার নাম ছিল "মাগুসাগুইয়া সামাসাশি"! (এইটা তার বানানো নাম, এইরকম অনন্ত সংখ্যক শব্দ সে বানাতে পারে, প্রয়োজনমত! 😁)
- এইটা ওর কাকার নাম?
- হুম!
- তারপর?
- ওর একটা দাদু ছিল, একটা দাদাভাই ছিল... ওরাও পান্তা পছন্দ করত। সবাই পান্তা পছন্দ করত।
- তারপর কি হল?
-...

(এভাবেই পান্তাবুড়ির গল্পের সাথে মিশে যায় বানরের গল্প! 🤣🤣🤣)

১১/০৬/২০১৯

Monday, June 10, 2019

বুক রিভিউ - একজন কমলালেবু : শাহাদুজ্জামান

শাহাদুজ্জামান একজন প্ৰতিথযশা কথাসাহিত্যিক; তার "একজন কমলালেবু" জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা হয়েছিল জানতাম কিন্তু কেন বইয়ের এমন নাম সেটি ধরতে পারিনি। যতটুকু জানতাম কখনো জীবনানন্দকে কমলালেবু নামে ডাকা হত বলে জানতাম না; শুধুমাত্র তার কবিতায় "কমলা" উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন:

"অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক;
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।"

অথবা...

"সুন্দর করুণ পাখা পড়ে আছে – দেখি আমি; – চুপে থেমে থাকি;
আকাশে কমলা রঙ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায় – কাকগুলো নীল মনে হয়;
অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই – কথা কই – হাতে হাত রাখি"

আরো কোথাও যেন কমলার ঘ্রাণের কথা উপমা হিসেবে এসেছে তাও এমন মনে হয়নি যে এটি তার প্রিয় উপমা যেমন প্রিয় রাত, শিশির, সমুদ্র, অন্ধকার বা নিঃশব্দ এসব।

ব্যাপার হচ্ছে বইটা শেষ করে হঠাৎ যেন মনে হল; নামটা কেন কমলালেবু হল ঠিক ধরতে পারলাম না! যদিও বইয়ের শেষে এসে দেখা যায় জীবনের শেষ সময়ে জীবনানন্দ কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন।
তাতে মন ভরে না!

"একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে"

যদিও আমি বইয়ের নামকরণ কেন এমন করা হল সেটি লিখতে বসিনি কিন্তু এগুলো এসেই যায়।

বেশ অনেক আগেই জীবনানন্দ দাসের রচনাসমগ্র পড়েছিলাম; কিছু বাদ দিয়ে প্রায় পুরো কবিতাগুলো! যখন আসলে কবিতা পড়ার "বয়স" বা সময় ছিলনা আমার। তখন মনে আছে খুব গদ্য পড়তে ইচ্ছে করত; কবিতার পাঠক হিসেবে ঠিক তৈরি হইনি। কিন্তু পুরো রচনাবলী পড়ে ফেলা গেল কেন সে কথায় পরে আসছি। ঐ কবিতা পড়ে মনে হয়েছিল "আচ্ছা! জীবনানন্দ গদ্য লেখেন নি!?" সবাই তো গদ্য লেখার চেষ্টা করেই (তখন হুমায়ুন পড়ে গদ্যের নেশা আছে মাথায়)। পরে খুঁজে  একটা জীবনানন্দের উপন্যাসসমগ্র পাওয়া গেছিল যদিও আর পড়া হয়নি কখনো; সেই গদ্যের দেখা মিলল এই বইতে! অগণিত; বোধকরি পদ্যের চাইতে অনেক বেশীই হবে যদিও মানের বিচারে হয়ত সেগুলো 'সাধারণ'!

লেখক জীবনানন্দ দাসের সব উপন্যাস পড়েছেন এবং পড়ে তাতে জীবনানন্দকে খুঁজবার ও বুঝাবার চেষ্টা করেছেন। লেখকের ব্যাবচ্ছেদের কাছে জীবনানন্দ যেন খোলা বইয়ের মত ধরা দিয়েছেন। সুবিধে হয়েছে জীবনানন্দের ডায়রী লেখার অভ্যেসটা থাকার কারণে, প্রায় সবকিছুই তিনি আকারে ইঙ্গিতে লিখে গেছেন; নিজের বোধের কথা, চাওয়া পাওয়া, কামনা ও যাপিত জীবনের কথা। যেন ভেবেই রেখেছিলেন "কেউ পড়বে"! ব্যাপারটা চমৎকার! আপনি যে লেখাগুলো পড়েছেন বা পড়বেন সেগুলোর পটভূমি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

যদি এককথায় আমি বলি, তবে তিনি তার মা কুসুমকুমারী দেবীর কবিতার মত "কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হও" (সেই অর্থে) "হতে পারেননি"! তিনি জীবনের শুরুতেই মাত্র কয়েক নাম্বারের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পাননি যা তাকে পুরো জীবন ভুগিয়েছে। চাকরি করতে গিয়ে বারবারই নিজের যোগ্যতার চাইতে বাবার সুপারিশ বা কারো অনুকম্পার বদৌলতে শিক্ষকতাকেই পেয়েছেন যদিও কখনো কীর্তিমান বা জনপ্রিয় শিক্ষক হতে পারেননি। একবার পেয়েছিলেন সংবাদপত্রের চাকরি যা তিনি নিজেই করতে পারেননি; ছেড়ে দিয়েছেন অন্য আর সব চাকুরির মত!

ব্যক্তি হিসেবে খুব মিশুক ছিলেন না, অন্তর্মুখী চরিত্রের অধিকারী যেমন ছিলেন তেমনি বাকপটু বা সুদর্শনও ছিলেন না; ফলে তার চারপাশের নিয়ন্ত্রণ তার নিজের ওপর কখনই ছিলনা। মা ছিলেন কুসুমকুমারী দেবী তার ছেলেকে তিনি একটি কবিতার জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যদিও কবিতার বিষয়ে ও চিন্তার জগতে জীবনানন্দ ছিলেন স্বতন্ত্র! এতটাই স্বতন্ত্র তার সমসাময়িক কবিরাও সেসব কবিতা নিতে পারেন নি। পাঠক তৈরী হয়েছিল অল্পই; এমনিতেই যেখানে কবিতার পাঠক বরাবরই কম। তার কিন্তু একটা ব্যাপার ছিল এমন যে...

"জীবনানন্দ পড়ার পর পাঠক আর আগের মত থাকেনা; অন্য এক জগতের খোজ সে পেয়ে যায়"!

ঠিক এ কারণেই হয়ত কৌশরে কবিতার পাঠক না হয়েও প্রায় পুরো কবিতাসমগ্র পড়ে ফেলেছিলাম। কেমন এক ঘোরলাগা অবস্থার তৈরী হয় তার কবিতা পড়লে!

শিশিরের শব্দ, উটের গ্রীবার মত নিস্তব্ধতা, রোদের গন্ধ... এমন উপমা কেউ কখনো শুনেছে আগে?... বা পরে??

তিনি বিয়ে করেছিলেন শিক্ষিতা, ইডেন পুড়ুয়া লাবণ্যকে। মোটামুটি পরিবারের পছন্দেই, নিজের পছন্দ "শোভনা" তখন তার জীবন থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, ধরাছোঁয়ার বাইরে, যদিও সারাটা জীবন সেই স্মৃতি নিয়েই কাটিয়েছেন। যে স্মৃতিকে ভুলে নতুন করে ভালোবাসার জগত তৈরী করতে চেয়েছিলেন, বিয়ের পরপরই হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়া, নিজের জগতের মাঝে স্ত্রীকে না জড়াতে পারা বা শিক্ষিত ও প্রগতিশীল স্ত্রীকে নিজের মত ভাঙতে গড়তে না পারা - সবমিলে বেকার প্রায় ৫ বছর তাকে বানিয়েছে অন্য মানুষ। অস্বাভাবিক এক বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ক্ষুধায় চড়ুইয়ের খাবারেও ভাগ বসাতে চেয়েছেন, হেন চাকুরি বা ব্যবসা নেই যার সম্ভবনার কথা ভাবেননি। জীবনে বারবার দারিদ্রতা তার থাবা বসিয়েছে; তিনি একটি চাকরির জন্য, সামান্য অর্থের জন্য অনুজের কাছে গেছেন, অকবিদের কাছে গেছেন। কিন্তু কিছুই তাকে ধরা দেয়নি। ফলে সময়ের স্রোতে তিনি আর স্বাভাবিক থাকেননি; খুব রুঢ়ভাবে বুঝেছেন দারিদ্রকে, জীবনে না পাওয়ার কষ্টকে; সুহৃদহীন এক অনন্ত একাকী জীবন। যার জন্য খেতাব পেয়েছেন "নির্জনতার কবি" হিসেবে। নানা বোধ খেলা করেছে তার মনে। অনি:শেষ অনুভূতির সাগরে ভাসতে ভাসতে শেষে আবিষ্কার করেছেন তার চেতনাকে; তাকে বলেছেন "বিপন্ন বিষ্ময়"!

যদিও মা'ই বোধকরি তার ছেলে "মিলু"কে সবচে ভালো বুঝেছিলেন। কিন্তু প্রায় পুরো জীবন ছেলেকে দেখতে পেয়েও তার প্রভাবের কোন চিহ্ন আর দেখা যায়না জীবনানন্দের জীবনে।

শিক্ষার শুরু বরিশালের ব্রজমোহন থেকে ম্যাট্রিক, আই এ (যে কলেজে পরে তিনি শিক্ষক হয়েছিলেন এওং দেশভাগের বিভক্তিতে আর ফিরতে পারেননি), বিএ প্রেসিডেন্সি, কলকাতা। মাঝে শুধু হাহাকারমাখা জীবনযাপন। জন্ম বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে আর মৃত্যু হল কলকাতার ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে, হিসেব করে বললে কলকাতার হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতেই। যদিও দেরীতে হলেও তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তাকে দেখতে এসেছিলেন এবং কেবিনে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কিন্তু শারিরীক অবস্থার কারণেই আর তাকে সরানো যায়নি। তবে পেয়েছিলেন মমতামাখা নার্সিং।

ছেলেমেয়েদের জন্য করতে পারেননি তেমন কিছুই, লাবণ্যের ভাষ্যে শুধু "নিখুঁত করে পেন্সিল কেটে দেয়া" ছাড়া! লাবণ্য তার জীবনে কোন লাবণ্য আনতে পারেননি কিন্তু জীবনানন্দের জীবনে আর কোন নারী আসেনি।

জীবনের ঠিক শেষদিকে এসে হয়ত একটু প্রচার পাচ্ছিলেন, একটু বহির্মুখীতা লক্ষ্য করা যায় কিন্তু মৃত্যুর ঠিক কদিন আগে থেকেই তার বিভিন্ন কাজ দেখে মনে হয় তিনি কি আসলে কোন মানসিক রোগ বা হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন নাকি নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহননের!? যদিও আত্মহননের চিন্তা তার নতুন নয় বারবারই এসেছে, পুরো জীবনই গভীর বিষন্নতায় ভুগেছেন; বলবার কাউকে পাননি, শোনাবার কেউ ছিলনা; বারবার ফিরে গেছেন কবিতার আশ্রয়ে; গদ্যের বুননে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেগুলোকে কখনই আলোতে আনেননি। শত প্রতিকূলতার মাঝে, বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দারিদ্রতার মাঝেও তিনি তার গদ্যেভরা কালো ট্রাঙ্কগুলো আগলে রেখেছেন। মনে গভীর গোপন আশা ছিল একদিন হয়ত গ্যেটে, ইয়টসের মত বড় সাহিত্যিক হবেন। যদিও জীবনের শেষে এসে তার কিছুটা মোহভঙ্গ হয়। তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন তা পারেননি বলে স্বীকার করে নেন কিন্তু তার কবিতা নিয়ে একটি নিজস্ব অহংকার সবসময়ই ছিল। তার কবিতাকে তিনি আগত কোন যুগের পাঠকের জন্য লিখছেন ভাবতেন। কখনো ভাবেননি, হয়ত আমিই ঠিক লিখছি না! এই একটিমাত্র যায়গায়তে তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

এবং তিনি সত্য ছিলেন তা আজ প্রমাণিত।

তার মৃত্যুর এতদিন পরে এসে তিনি আরো বেশী বেশী আলোচিত।

০৫/০৬/২০১৯