Thursday, April 12, 2018

হাসপাতালে প্রজাপতি নেই!

আমি একজন বাবা। আমার একটা ছোট্ট পৃথীবি আছে, বয়স ২ এর কিছু বেশী, আমরা ওকে সাম্মি ডাকি। এই বয়সেই তার রাজ্যের প্রশ্ন! বয়সটাই প্রশ্নের!
‎- বাবা! কোথাও গিয়েছিলে?
‎- বাবা তো হাসপাতালে গিয়েছিলাম মা! (ও আমি একজন চিকিৎসকও বটে)
‎- সেখানে কে থাকে?
‎- সেখানে বাবুরাও থাকে, আংকেলও থাকে, খালামনিরাও থাকে। ওরা দুত্তুমি করে ব্যথা পেয়েছে তো তাই বাবা ওদের দেখতে যাই।
‎- সেখানে বাবুরা কি করে? আর কে থাকে? সাম্মিও সেখানে যাবে?

ক্লান্ত-ব্যস্ত চিকিৎসকেরও মহানন্দের রাত আসে! রাতে পুরো পৃথীবিকে কোলে নিয়ে ঘুমানো যায়! তাকে প্রায় রাতেই গল্প শোনাতে হয়, আমাদের ও তার ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসলেও "বাবা! গল্প বলো"! আমি শুর করি আর শেষটা করতে হয় তার মামকে!

তাকে গল্প বলতে হয়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি নিজেই কি আর অত গল্প জানি! তারপরেও তাকে কোলে নিয়ে রাতে গল্প শোনাই। এক আনন্দময় রঙিন দেশের গল্প! সেখানে অনেক অনেক ফুল থাকে, সবুজ ঘাসের মাঠ থাকে, বড় বড় গাছ থাকে, গাছে দোয়াল, চড়ুইয়া, বুলবুলি, টিয়া, ময়না থেকে শুরু করে ঈগল পাখিও থাকে! সেদেশের প্রায় সব গাছেই কাঠবিড়ালি থাকে, সে যে গাছই হোক তারা সেখানে পেয়ারা খায়! আর থাকে টাট্টু ঘোড়া, টবগ টবগ করে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে চলে। সাম্মী টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিন্তু পড়ে যায়না। টাট্টু ঘোড়ার সাথে পংখীরাজও থাকে কিন্তু পংখীরাজ টাট্টুঘোড়ার সাথে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা! কোন খেলাতেই টাট্টুঘোড়ার সাথে পারে না; না দৌড়ে; না ঝাপাঝাপিতে। সেখানে খরগোস থাকে, মিমিউ থাকে, অনেক কুকুর থাকে, পান্ডা থাকে, বাঘ থাকে, সিংহ থাকে, হাতি, জেব্রা, জিরাফও থাকে। ওরা সবাই সাম্মির সাথে খেলতে চায়! সাম্মিকে সবাই আদর করে।

ও! আর সেই সওদাগর আর ময়না পাখির কথা তো বলাই হয়নি। এটা "মোস্ট ডিমান্ডিং ওয়ান"! 'অনেক ছোটবেলা' থেকেই সে এই গল্প শুনে আসছে, 'এখন তো সাম্মী বড় হয়ে গেছে'; কিন্তু গল্পের আবেদন কমছে না! প্রতিদিন একই গল্প শুনতে যে কত ভালো লাগে! প্রতিরাতে নতুন একটু যোগ হতে হতে আজ ডালপালা মেলে পুরো গল্পের সংসার! সেখানে ময়না পাখির অনেক বুদ্ধি! সে সবাইকে বলে দেয় কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা পচা কাজ; পচা কাজ করলে তো কেউ সাম্মিকে আদর করেনা আর লক্ষীসোনা চাঁদেরকণাও বলে না! (এখানে আবার ময়না পাখির কণ্ঠ দিতে হয়, সওদাগরের কণ্ঠ দিতে হয়, সবাই তো আলাদা করেই কথা বলে!) গোসল করা ছাড়া, পানি নিয়ে খেলা করা হচ্ছে এখানে সবচেয়ে পচা কাজ!

তো আমার মেয়ের রাজ্যে তো অনেক আনন্দ! এক সাম্মিময় রাজ্য। সেদিন রাতে তাকে শোনাচ্ছিলাম সওদাগরের প্রজাপতি ধরার গল্প। প্রজাপতি কেন পেয়ারা খায়না সেই ব্যাখ্যায় আসতেই -
- বাবা! তোমার হাসপাতালে কি প্রজাপতি আছে? (সকালে উঠেই বাবা-মাম সাম্মীকে রেখে হাসপাতালে চলে যায়, শুয়ে শুয়ে এটাই ভাবছিল বোধকরি!)
- ‎হাসপাতালে কি প্রজাপতি থাকে মা?
- ‎ঐ যে বাবুরা থাকে!
- ‎তাই তো! বাবুরা থাকে প্রজাপতি তো থাকারই কথা!
- ‎সেখানে কি অনেক ফুল থাকে? সেখানে প্রজাপতি খেলা করে?
- ‎হ্যা মা! সেখানে অনেক ফুল থাকে! সেখানে অনেক প্রজাপতি থাকে। ওরা উড়ে উড়ে ফুলের সাথে খেলা করে। বাবুরাও ফুলের সাথে খেলা করে।

মেয়েকে তো বলি ফুল থাকে, প্রজাপতি থাকে। আসলে তো আমি জানি সরকারি হাসপাতালে কি থাকে। প্রতিটি দিনের আলোটুকুর পুরোটা সময়, কত গোধূলী-সন্ধ্যা আর নির্ঘুম রাত কেটে যায় যে হাসপাতালে সেখানে তো কোন সবুজ গাছ নেই, কোন ফুল নেই, পাখিও নেই, প্রজাপতিও নেই।

আহা! এত রোগ-শোকে আর ক্লান্তি দুখের আধারের মাঝে একটু যদি ফুল-পাখি-প্রজাপতি থাকতো! কত দারুনই না হত! এই এক জীবনের জন্য কি খুব বেশী চাওয়া? আমাদের শিশুদের জন্য, আমাদের জন্য এই গল্পগুলো সত্যি হলেও তো পারে!