Saturday, March 12, 2016

শিশুদের জন্য নিরাপদ কি "আমরা"?


যতদিন এই দেহে আছে প্রাণ,
প্রানপনে সরাবো পৃথিবীর জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।

কিশোর কবি সুকান্ত চেয়েছিলেন পৃথিবীর যত জঞ্জাল সরিয়ে আমাদের আজকের ও আগামী দিনের শিশুর জন্য ‘বাসযোগ’ ও ‘নিরাপদ’ একটি পৃথিবী রেখে যেতে। আর আজকের বাস্তবাতায় পত্রিকার পাতা খুললে ‘পৃথিবী’ কতটা বাসযোগ্য হয়েছে তার চাইতে বড় হয়ে দেখা দেয় ‘আমরা’ কতটা ‘নিরাপদ’ হতে পেরেছি শিশুদের জন্য, আমাদের চারপাশ কতটা নিরাপদ হয়েছে শিশুদের জন্য!?

গত বছর জুলাই পর্যন্ত করা একটি পরিসংখ্যান বলছে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত ১৯১ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, যা গত বছরগুলোতে ছিল ৩৫০ (২০১৪), ২১৮ (২০১৩) ও ২০৯ (২০১২)। বিভিন্ন সংগঠন ও গণমাধ্যমের করা এই পরিসংখ্যান এর প্রতিক্রিয়ায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ  স্বীকার করে নেন “প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশী”। চলতি বছরের জুলাই নাগাদ পরিসংখ্যান শেষে এ সংখ্যা আরো বাড়বে তা নিঃসন্দেহে আশঙ্কা করা যায়। সেই সাথে আরো আশঙ্কার কথা হচ্ছে এই শিশু নির্যাতনের ‘ভয়াবহতা’ও বেড়ে চলেছে।

আমরা মনে করতে পারি গেল বছরের সিলেটের শেখ মো। সামিউল আলম রাজন (১৩) এর কথা, যাকে সামান্য করণে ‘পিটিয়ে’ হত্যা করা হয়। ময়না তদন্তে তার শরিরে ৬৪ টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েচিল। অতটুকু শরিরে ৬৪ টি আঘাত! এবং এটির ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা অন্তর্যালে ছড়িয়ে দেয়া মধ্যযুগীয় মানসকতাকেও হার মানায়। অথবা খুলনার রাকিব (১২) এর কথা। যে নির্যাতন সইতে না পেরে গ্যারেজ পরিবর্তন করেও প্রাণে বাচতে পারেনি। চাকায় বাতাস দেয়ার কম্প্রেসার তার পায়ুপথ দিয়ে ঢুকিয়ে তার শরিরকে ‘ফোলানো’ হয়, এক পর্যায়ে তার ছোট্ট শরির বড়দের মত ফুলে ওঠে এবং পেটের নাড়িভুড়ি (খাদ্যনালী) এমনকি ফুসফুসও ‘ফুলে ফেটে’ গিয়ে তার মৃত্যু হয়!

আমরা একটু থেমে নিতে পারি...

ঠিক কতটা পৈশাচিকতা মানুষের মনে লুকানো থাকলে এভাবে শিশুহত্যা করা যায়!?
আর এমন উদাহরণ এখন অহরহ আমাদের চারপাশে। প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক বেশী। আমরা কাছের মানুষেরাই নিজেদের দ্বন্দ্বের জের’এর শিকার বানাচ্ছি শিশুদের; সম্পত্তির জের ধরে একসাথে চারজনকে হত্যা করে বালুতে পুতে ফেলছি, সামান্য মাছ চুরির অপরাধে আওয়ালদের চোখ তুলে মেরে ফেলছি, অপহরণ করে বস্তাবন্দী করে ফেলছি এবং সবচাইতে হতাশার কথা হচ্ছে শিশুর সবচাইতে আপনজন মা-বাবা তারাও সবক্ষেত্রে শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। মা হয়ে দুই সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে দেয়া, গলাকেটে হত্যা করা এনং সপ্রতি পরকীয়ার জের ধরে দুই শিশুকে শ্বসরোধ করে হত্যা তারই প্রমাণ দেয়।

মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ, সেগুলো নানা সামাজিক কারণে সামনে আসেও কম। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৩ জন মেয়ে শিশুর দুই জনই তার শৈশব-কৈশরে যৌণ নির্যানতের স্বীকার! এবং এগুলো বেশীরভাগই ঘটছে তাদের কাছর মানুষ ও আপনজনদের দ্বারা! ছেলে শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়, তাদের ক্ষেত্রেও নির্যাতনকারী ‘কাছের মানুষ’ বা ‘পরিচিতজন’!

শিশু হত্যা ও নির্যাতনের এই চিত্রই প্রকাশ করে ভেতরে ভেতরে আমাদের মানসিকতা কতটা পৈশাচিক হয়ে উঠেছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে রাজন বা রাকিবের কিন্তু এ বয়সে থাকার কথা স্কুলে, কোনমতেই তাদের এসব জায়গায় থাকার কথা না। রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা অদক্ষতাই হোক আর সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই হোক ‘শিশুশ্রম’ আমরা বন্ধ করতে পারিনি উপরন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় আমরা শিশুদেরকে ‘ব্যাবহৃত” হতে দেখেছি।

আমরা নিজেরাই শিশুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছি, আমাদের স্বার্থ আদায়ে আমরা দুর্বল শিশুদের ব্যাবহার করছি। আমাদের মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। “আগামী দিনের ভবিষ্যত” শিশুদের আমরাই নিজেদের হাতে হত্যা করছি, নির্যাতন করছি যা আমাদের একটি ‘অন্ধকার’ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। যে সমাজে শিশুরাই ভালো করে বেড়ে উঠতে পারেনা তার “সুন্দর ভবিষ্যত” কেবলমাত্র কল্পনাতেই, বাস্তবে ‘অসম্ভব’।

তাই এখনই সময়, খুব বেশী দেরি হয়ে যাবার আগেই আমাদের উচিত আমাদের ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া। শিশুদের জন্য আমদের চারপাশকে ‘উপযোগী’ করে তোলা, মানসিকতার পরিবর্তন করা, সামাজিক অস্থিরতা কমিয়ে আনা, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা, সর্বপরি নিজেদের কাছে নিজেদের এই প্রশ্ন রাখা,

শিশুদের জন্য কি নিরাপদ “আমরা”?

@আহমেদুর রহমান সবুজ , ০৩,০৩,২০১৬

আমাদের শিশুদের মনোজগৎ

"ছুটি" গল্পের ফটিক’কে কে মনে আছে আপনাদের?

গল্পের শুরুটাই এমনঃ “বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাব উদয় হইল, নদীর ধারে একটা প্রকান্ড শালকাঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে। যে ব্যাক্তির কাঠ আবশ্যককালে তাহার যে কতখানি বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলদ্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।”

এখানে এই বয়াকলসকলের সর্দার ছিল ফটিক, যত উদ্ভট ও দুঃসাহসিক কাজে সে সবার আগে, সে সমবয়সীদের মাঝে এসব কাজে নেতা। তাকে চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়
“ঐ হোথা”
কোথা?
“জানি নে”

এই ছিল তার উত্তর! ছোট ভাই মাখনলালকে মারার অভিযোগ আনা হলে তার মা তাকে শাসন করতে চাইলে সে মাকে ঠেলে দেয়।

যদিও রবীন্দ্রণাথ খুব সুন্দর করে লিখেছিলেনঃ
“তেরো চোদ্দ বৎসরের ছেলের মত এমন বালাই আর পৃথিবীতে নাই। শোভাও নাই, কোন কাজেও লাগেনা। স্নেহও উদ্রেক করেনা, তাহার সঙ্গসুখো বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা”।

কিন্তু আমাদের আধুনিকে সাইকিয়াট্রি বলে যে ফটিক ছিল “কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার” (Conduct Disorder) এর কিশোর!

আবার কাবুলিওয়ালা গল্পের “মিনি” কি মনে আছে আপনাদের?

সেখানেও গল্পের শুরুটা এমনঃ “আমার পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে মিনি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারেনা। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষাশিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসরকাল ব্যয় করিয়াছিল, তারপর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌণভাবে নষ্ট করেনা”।

মিনি এখানে এমন একটি শিশু যে  ঠিক নির্দিষ্ট একটি বিষিয়ে বেশীক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতে পারেনা, তার আগ্রহের বিষয়বস্তু প্রতিক্ষণেই পরিবর্তন হয়, প্রশ্ন করে সে তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার প্রশ্ন করে। হুট করে সে যেমন ঘরে এসে কোন এক খেলা জুড়ে দেয় তেমনি এক ছুট দিয়ে সে আবার কোথায় খেলা ফেলে চলে যায়।
এই দুরন্ত বাচ্চাটি হয়ত ছিল “হাইপার এক্টিভ এ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার” (ADHD) এর শিশু!

আবার হৈমন্তির কি সমস্যা ছিল? হৈমন্তি ভুগছিল মাইনর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার এ!
বা রামের সুমতির রামকে!?

কী! সবটা শুনে কি মনে হচ্ছে যে আমি আসলে বায়াসড বা বেশী পড়ে সবাইকে এক কাতারে দাড় করিয়ে দিচ্ছি?  যদি তাই মনে হয় তবে আমি ঠিকই আছি!

জাতিগতভাবেই আমরা অনেকটা ‘সাবমিসিভ’ ক্যাটাগরির! কারণ বৈশিষ্ঠ অনুযায়ী আমরা "নট ওয়েট ফর হিজ অর হার টার্ন" টাইপ; সর্বত্র আমাদের প্রতিযোগীতা এবং সেটা অন্যকে "বঞ্চিত" করে হলেও! তাই নয় কি?

এছাড়া আমাদের সাহিত্যের চরিত্রগুলোও ঠিক সেই প্রমাণই দেয় যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেমন ছিলেন! নইলে কি আর ইংরেজদের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে আমাদের দুইশ বছর লাগে! এই উপমহাদেশ যখন সিংহলের সাথে দারুচিনি আর এলাচের বাণিজ্য করে তখন মাত্র ভাস্কো-দা-গামা আমেকিরা “আবিষ্কার” করেন!

আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও সাহিত্যিক কিন্তু একিটি সাধারণ আটপৌরে জীবনের কোন বৈচিত্রহীন চরিত্র নিয়ে কাজ করেন না; যেখানেই চারিত্রিক বিচিত্রতা আছে সাহিত্যিক সেটাকেই তার বিষয় করে এগোন। আর সাইকোলজিকালি অন্যদের চেয়ে যারা আলাদা তারাই পাঠকের এবং প্রকারন্তরে লেখকের আকর্ষণের বিষয় হবেন এটিই স্বাভাবিক।  তাই নয় কী?

আমি কি লেখক সাহিত্যিকদের মন:ব্যাবচ্ছেদ করে ফেল্লাম নাকি!? রবীন্দ্রণাথ-শরতেরা যেভাবে চরিত্র বিশ্লেষণ করে গেছেন তার সাহিত্যমূল্যের পাশাপাশি “প্রত্নতাত্ত্বিক” মুল্য কিছু কম নয়! তবে আমাদের সবার কাছে তুঙ্গস্পর্শী ভালোলাগার যে লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার চরিত্রগুলো চিত্রায়ন বৈশিষ্ঠ কিন্তু উপরের কথাগুলোকেই সাপোর্ট করে!
গভীরভাবে ভেবে দেখবার বিষয়!

সাইকিয়াট্রির মজাটাই এখানে; আর এ জন্যই আমার মত অভাজন এত্ত আগ্রহের সাথে এত্তগুলো কথা বলছে! তবে সব শিশুকেই দু একটি সিম্পটম দেখেই একটা ডায়াগনোসিস ট্যাগ করে দেয়া ঠিক নয়, সচেতন থাকা অবশ্যক যেন তার মানসিকতাকে ঠিক পথে চালানো যায়। এসব অনেক পজিটিভ হিস্ট্রি থাকার পরেও অনেক শিশু মহামানবের খাতায় নাম লিখিয়েছেন সেই উদাহরণও আছে। তাই সব শিশুর শৈশব হোক আমাদের সচেতনায় আরো আলোকিত, ভবিষ্যৎ হোক আমিত সম্ভবনাময়!
(লেখার অনেক জায়গাতেই সচেতনভাবেই সরাসরি ইংরেজি ব্যাবহার না করে বাংলা লেখা হয়েছে, পাঠকের মার্জনা অনুগৃহীত)
Sabuj.mmc@gmail.com