যতদিন এই দেহে আছে প্রাণ,
প্রানপনে সরাবো পৃথিবীর জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।
কিশোর কবি সুকান্ত চেয়েছিলেন পৃথিবীর যত জঞ্জাল সরিয়ে আমাদের আজকের ও আগামী দিনের শিশুর জন্য ‘বাসযোগ’ ও ‘নিরাপদ’ একটি পৃথিবী রেখে যেতে। আর আজকের বাস্তবাতায় পত্রিকার পাতা খুললে ‘পৃথিবী’ কতটা বাসযোগ্য হয়েছে তার চাইতে বড় হয়ে দেখা দেয় ‘আমরা’ কতটা ‘নিরাপদ’ হতে পেরেছি শিশুদের জন্য, আমাদের চারপাশ কতটা নিরাপদ হয়েছে শিশুদের জন্য!?
গত বছর জুলাই পর্যন্ত করা একটি পরিসংখ্যান বলছে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত ১৯১ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, যা গত বছরগুলোতে ছিল ৩৫০ (২০১৪), ২১৮ (২০১৩) ও ২০৯ (২০১২)। বিভিন্ন সংগঠন ও গণমাধ্যমের করা এই পরিসংখ্যান এর প্রতিক্রিয়ায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ স্বীকার করে নেন “প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশী”। চলতি বছরের জুলাই নাগাদ পরিসংখ্যান শেষে এ সংখ্যা আরো বাড়বে তা নিঃসন্দেহে আশঙ্কা করা যায়। সেই সাথে আরো আশঙ্কার কথা হচ্ছে এই শিশু নির্যাতনের ‘ভয়াবহতা’ও বেড়ে চলেছে।
আমরা মনে করতে পারি গেল বছরের সিলেটের শেখ মো। সামিউল আলম রাজন (১৩) এর কথা, যাকে সামান্য করণে ‘পিটিয়ে’ হত্যা করা হয়। ময়না তদন্তে তার শরিরে ৬৪ টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েচিল। অতটুকু শরিরে ৬৪ টি আঘাত! এবং এটির ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা অন্তর্যালে ছড়িয়ে দেয়া মধ্যযুগীয় মানসকতাকেও হার মানায়। অথবা খুলনার রাকিব (১২) এর কথা। যে নির্যাতন সইতে না পেরে গ্যারেজ পরিবর্তন করেও প্রাণে বাচতে পারেনি। চাকায় বাতাস দেয়ার কম্প্রেসার তার পায়ুপথ দিয়ে ঢুকিয়ে তার শরিরকে ‘ফোলানো’ হয়, এক পর্যায়ে তার ছোট্ট শরির বড়দের মত ফুলে ওঠে এবং পেটের নাড়িভুড়ি (খাদ্যনালী) এমনকি ফুসফুসও ‘ফুলে ফেটে’ গিয়ে তার মৃত্যু হয়!
আমরা একটু থেমে নিতে পারি...
ঠিক কতটা পৈশাচিকতা মানুষের মনে লুকানো থাকলে এভাবে শিশুহত্যা করা যায়!?
আর এমন উদাহরণ এখন অহরহ আমাদের চারপাশে। প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক বেশী। আমরা কাছের মানুষেরাই নিজেদের দ্বন্দ্বের জের’এর শিকার বানাচ্ছি শিশুদের; সম্পত্তির জের ধরে একসাথে চারজনকে হত্যা করে বালুতে পুতে ফেলছি, সামান্য মাছ চুরির অপরাধে আওয়ালদের চোখ তুলে মেরে ফেলছি, অপহরণ করে বস্তাবন্দী করে ফেলছি এবং সবচাইতে হতাশার কথা হচ্ছে শিশুর সবচাইতে আপনজন মা-বাবা তারাও সবক্ষেত্রে শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। মা হয়ে দুই সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে দেয়া, গলাকেটে হত্যা করা এনং সপ্রতি পরকীয়ার জের ধরে দুই শিশুকে শ্বসরোধ করে হত্যা তারই প্রমাণ দেয়।
মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ, সেগুলো নানা সামাজিক কারণে সামনে আসেও কম। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৩ জন মেয়ে শিশুর দুই জনই তার শৈশব-কৈশরে যৌণ নির্যানতের স্বীকার! এবং এগুলো বেশীরভাগই ঘটছে তাদের কাছর মানুষ ও আপনজনদের দ্বারা! ছেলে শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়, তাদের ক্ষেত্রেও নির্যাতনকারী ‘কাছের মানুষ’ বা ‘পরিচিতজন’!
শিশু হত্যা ও নির্যাতনের এই চিত্রই প্রকাশ করে ভেতরে ভেতরে আমাদের মানসিকতা কতটা পৈশাচিক হয়ে উঠেছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে রাজন বা রাকিবের কিন্তু এ বয়সে থাকার কথা স্কুলে, কোনমতেই তাদের এসব জায়গায় থাকার কথা না। রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা অদক্ষতাই হোক আর সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই হোক ‘শিশুশ্রম’ আমরা বন্ধ করতে পারিনি উপরন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় আমরা শিশুদেরকে ‘ব্যাবহৃত” হতে দেখেছি।
আমরা নিজেরাই শিশুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছি, আমাদের স্বার্থ আদায়ে আমরা দুর্বল শিশুদের ব্যাবহার করছি। আমাদের মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। “আগামী দিনের ভবিষ্যত” শিশুদের আমরাই নিজেদের হাতে হত্যা করছি, নির্যাতন করছি যা আমাদের একটি ‘অন্ধকার’ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। যে সমাজে শিশুরাই ভালো করে বেড়ে উঠতে পারেনা তার “সুন্দর ভবিষ্যত” কেবলমাত্র কল্পনাতেই, বাস্তবে ‘অসম্ভব’।
তাই এখনই সময়, খুব বেশী দেরি হয়ে যাবার আগেই আমাদের উচিত আমাদের ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া। শিশুদের জন্য আমদের চারপাশকে ‘উপযোগী’ করে তোলা, মানসিকতার পরিবর্তন করা, সামাজিক অস্থিরতা কমিয়ে আনা, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা, সর্বপরি নিজেদের কাছে নিজেদের এই প্রশ্ন রাখা,
শিশুদের জন্য কি নিরাপদ “আমরা”?
@আহমেদুর রহমান সবুজ , ০৩,০৩,২০১৬