"ছুটি" গল্পের ফটিক’কে কে মনে আছে আপনাদের?
গল্পের শুরুটাই এমনঃ “বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাব উদয় হইল, নদীর ধারে একটা প্রকান্ড শালকাঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে। যে ব্যাক্তির কাঠ আবশ্যককালে তাহার যে কতখানি বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলদ্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।”
এখানে এই বয়াকলসকলের সর্দার ছিল ফটিক, যত উদ্ভট ও দুঃসাহসিক কাজে সে সবার আগে, সে সমবয়সীদের মাঝে এসব কাজে নেতা। তাকে চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়
“ঐ হোথা”
কোথা?
“জানি নে”
এই ছিল তার উত্তর! ছোট ভাই মাখনলালকে মারার অভিযোগ আনা হলে তার মা তাকে শাসন করতে চাইলে সে মাকে ঠেলে দেয়।
যদিও রবীন্দ্রণাথ খুব সুন্দর করে লিখেছিলেনঃ
“তেরো চোদ্দ বৎসরের ছেলের মত এমন বালাই আর পৃথিবীতে নাই। শোভাও নাই, কোন কাজেও লাগেনা। স্নেহও উদ্রেক করেনা, তাহার সঙ্গসুখো বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা”।
কিন্তু আমাদের আধুনিকে সাইকিয়াট্রি বলে যে ফটিক ছিল “কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার” (Conduct Disorder) এর কিশোর!
আবার কাবুলিওয়ালা গল্পের “মিনি” কি মনে আছে আপনাদের?
সেখানেও গল্পের শুরুটা এমনঃ “আমার পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে মিনি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারেনা। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষাশিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসরকাল ব্যয় করিয়াছিল, তারপর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌণভাবে নষ্ট করেনা”।
মিনি এখানে এমন একটি শিশু যে ঠিক নির্দিষ্ট একটি বিষিয়ে বেশীক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতে পারেনা, তার আগ্রহের বিষয়বস্তু প্রতিক্ষণেই পরিবর্তন হয়, প্রশ্ন করে সে তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার প্রশ্ন করে। হুট করে সে যেমন ঘরে এসে কোন এক খেলা জুড়ে দেয় তেমনি এক ছুট দিয়ে সে আবার কোথায় খেলা ফেলে চলে যায়।
এই দুরন্ত বাচ্চাটি হয়ত ছিল “হাইপার এক্টিভ এ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার” (ADHD) এর শিশু!
আবার হৈমন্তির কি সমস্যা ছিল? হৈমন্তি ভুগছিল মাইনর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার এ!
বা রামের সুমতির রামকে!?
কী! সবটা শুনে কি মনে হচ্ছে যে আমি আসলে বায়াসড বা বেশী পড়ে সবাইকে এক কাতারে দাড় করিয়ে দিচ্ছি? যদি তাই মনে হয় তবে আমি ঠিকই আছি!
জাতিগতভাবেই আমরা অনেকটা ‘সাবমিসিভ’ ক্যাটাগরির! কারণ বৈশিষ্ঠ অনুযায়ী আমরা "নট ওয়েট ফর হিজ অর হার টার্ন" টাইপ; সর্বত্র আমাদের প্রতিযোগীতা এবং সেটা অন্যকে "বঞ্চিত" করে হলেও! তাই নয় কি?
এছাড়া আমাদের সাহিত্যের চরিত্রগুলোও ঠিক সেই প্রমাণই দেয় যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেমন ছিলেন! নইলে কি আর ইংরেজদের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে আমাদের দুইশ বছর লাগে! এই উপমহাদেশ যখন সিংহলের সাথে দারুচিনি আর এলাচের বাণিজ্য করে তখন মাত্র ভাস্কো-দা-গামা আমেকিরা “আবিষ্কার” করেন!
আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও সাহিত্যিক কিন্তু একিটি সাধারণ আটপৌরে জীবনের কোন বৈচিত্রহীন চরিত্র নিয়ে কাজ করেন না; যেখানেই চারিত্রিক বিচিত্রতা আছে সাহিত্যিক সেটাকেই তার বিষয় করে এগোন। আর সাইকোলজিকালি অন্যদের চেয়ে যারা আলাদা তারাই পাঠকের এবং প্রকারন্তরে লেখকের আকর্ষণের বিষয় হবেন এটিই স্বাভাবিক। তাই নয় কী?
আমি কি লেখক সাহিত্যিকদের মন:ব্যাবচ্ছেদ করে ফেল্লাম নাকি!? রবীন্দ্রণাথ-শরতেরা যেভাবে চরিত্র বিশ্লেষণ করে গেছেন তার সাহিত্যমূল্যের পাশাপাশি “প্রত্নতাত্ত্বিক” মুল্য কিছু কম নয়! তবে আমাদের সবার কাছে তুঙ্গস্পর্শী ভালোলাগার যে লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার চরিত্রগুলো চিত্রায়ন বৈশিষ্ঠ কিন্তু উপরের কথাগুলোকেই সাপোর্ট করে!
গভীরভাবে ভেবে দেখবার বিষয়!
সাইকিয়াট্রির মজাটাই এখানে; আর এ জন্যই আমার মত অভাজন এত্ত আগ্রহের সাথে এত্তগুলো কথা বলছে! তবে সব শিশুকেই দু একটি সিম্পটম দেখেই একটা ডায়াগনোসিস ট্যাগ করে দেয়া ঠিক নয়, সচেতন থাকা অবশ্যক যেন তার মানসিকতাকে ঠিক পথে চালানো যায়। এসব অনেক পজিটিভ হিস্ট্রি থাকার পরেও অনেক শিশু মহামানবের খাতায় নাম লিখিয়েছেন সেই উদাহরণও আছে। তাই সব শিশুর শৈশব হোক আমাদের সচেতনায় আরো আলোকিত, ভবিষ্যৎ হোক আমিত সম্ভবনাময়!
(লেখার অনেক জায়গাতেই সচেতনভাবেই সরাসরি ইংরেজি ব্যাবহার না করে বাংলা লেখা হয়েছে, পাঠকের মার্জনা অনুগৃহীত)
Sabuj.mmc@gmail.com