আমি প্রথম আমার জানামতে “ব্যবহৃত”
হয়ে গেলাম আমার ইন্টার্নশিপ সময়। সার্জারী
ওয়ার্ড চলাকালীন সময়। আগের রাতে ইমার্জেন্সি ওটি করার পর শুক্রবার সকালেও আছি
ওয়ার্ডে। এক রোগীর লোকজন আসলো একটা বড় জারে করে ভিসেরা নিয়ে (সম্ভবত রিসেকটেড
পার্ট অফ ইনটেস্টাইন ছিল), এইটা সে কোথায় পরীক্ষা করাবে। সাথে আমাদের ওয়ার্ডের এক
ওয়ার্ডবয়। কথায় বুঝলাম আগের রাতে যে কাগজ লিখে দেয়া ছিল তা তারা হারিয়ে ফেলেছে
(এইটাই স্বাভাবিক তারা সামান্য সাপোজিটরি কেনার “টাকার রসিদ” যত্নে রেখে দেয় আর সব
গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হারিয়ে ফেলে)। তো আবার লিখে দিলাম এরেকটা কাগজে সর্ট হিস্ট্রি
আর ইন্ডিকেশন, অপারেশনসহ ডিটেইল, বললাম “মির্জা প্যাথলজিতে” যান ঐখানে এই পরীক্ষা
সবচে ভালো হবে; সরকারীভাবে আমাদের
হাসপাতালে হিস্টপ্যাথলজী পরীক্ষা করার সুযোগ ছিলনা।
কিছুক্ষন পর আবার তাদের আগমন, এইবার সাথে আমাদের
ওয়ার্ডের ওয়ার্ডবয়;
-স্যার গরীব মানুষ, একটু কম লিখে দেন।
আমরা সাধারণত সবাইকেই বাইরে “ডিসকাউন্ট অ্যাস
পসিবল” লিখে দিতাম কিন্তু প্রবাদপ্রতিম
মির্জা স্যারের একটা ব্যাপার ছিল তিনি সাধারণত কোন "কম রাখা" বা
“ডিসকাউন্ট”কে উৎসাহিত করতেন না, তার উপর আবার হিস্টোপ্যাথলজিতে! এতকিছু রোগীর
লোকজনকে বোঝানো চেষ্টা করাই বৃথা তাই আমি লিখে দিলাম। কিছুক্ষন পর আমি নামাযের
জন্য বের হতে ওয়ার্ডের মুখেই দেখলাম ওয়ার্ডবয় রোগীর এক লোককে বলছে- “এই পরীক্ষার
দাম এক হাজার টাকা, দেখছেন আমি ফিফটি পারসেন্ট কমাইয়া দিলাম! দেন আমারে ৪০০ টাকা
দেন!” ওই ব্যাটার ঝাড়িতেই হোক আর দাপটেই হোক রোগীর লোক সেটা বের করে দিল। এরই মাঝে
আমাকে দেখে ফেলায় ওয়ার্ডবয় রোগীর লোকদের ‘যান যান তাড়াতাড়ি যান’ বলে দূরে সরিয়ে
নিল। ঘটনাটা আমার কাছে এতই আকস্মিক আর অপ্রত্যাশিত ছিল যে আমি মুক’এর মত দাঁড়িয়ে
রইলাম!
তো এইভাবেই আমি আমার
“গোচরে” প্রথম বিক্রি হয়ে গেলাম! অগোচরে আরো কতবার হয়েছি তার ইয়ত্তা নাই!
আমরা ভর্তি রোগীর
‘ক্যাথেটার’ না করলে ওয়ার্ডবয়রা করে টাকা নিত আর ওরাই আরো ইনফেকশন’এর রাস্তা তৈরী
করে দিত তাই অ্যাাডমিশনের দিন দম ফেলবার সময় না থাকার পরেও সবার ক্যাথেটার নিজেরাই
করে দিতাম। পরে শুনতাম আমরা রোগীকে ক্যাথেটার করার জন্য নাকি চার্জ নিই (আমাদের
হয়ে ওয়ার্ডবয় সেই টাকা তোলে!)। দু একজন সচেতন রোগীর জন্য হয়ত এগুলো কদাচিৎ জানা
যেত আর বাকিসব এভাবেই চলত। আমরা সার্ভিস দেই নিজেদের সবটা দিয়ে “বিনামূল্যে” আর ওদিকে
“নিজেরাই বিক্রি হয়ে যাই” ঠিক এই ব্যপারটাই হচ্ছে এখন আমার উপজেলায়! এখানে
ইমার্জন্সি কাটা ছেড়া থেকে মুসলমানীর মত মাইনর সার্জারীও করে ফেলে ওয়ার্ডবয়! আমরা
এসে সব নিজেরা ফ্রি’তে করা শুরু করলাম। পরে দেখি আমাদের অগোচরে পেশেন্টের কাছ থেকে
ওরা!
আউটডোরে আমরা সব রোগী
দেখি এক্কেবারেই বিনামূল্যে কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে আগেই হয়ত আমার ভিজিট নেয়া হয়ে
গেছে! আমি আমার আজন্তেই বিক্রি হয়ে গেছি ১০, ২০, ৫০ বা ২০০ টাকায়!!!
এভাবেই আমরা ডাক্তারেরা
ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন আমাদের আজন্তেই!
উপজেলায় এখন যথেষ্ট
পরিমান “গ্যাসের ওষুধ” (ইসওমেপ্রাজল) সরবরাহ আছে। লোকে যখন সরাসরি “গ্যাসের ওষুধ”
চায় তখন দিই না বলে তারা এখন বানিয়ে বলে “স্যার শুধু গ্যাসের সমস্যা, আর কোন
সমস্যা নাই”! আমদের আর কি করার থাকে, ওরাও আমাদের ব্যবহার করে!
হয়ত মধ্যারাতে আপনার
দরজায় কড়া নাড়া বা দজরা’র নাগাল না পেয়ে জানালায় টোকা! “স্যার! ওঠেন আমার বাচ্চা
অসুস্থ!” আপনি আর সইতে না পেরে মহানুভব হয়ে যদি উঠেই পড়েন তবে যেহেতু “আপনারও
বাবা-মা-সন্তান আছে” তাই আপনিও “মনবতা” দেখাতে বাধ্য হবেন! এবং অবশ্যই আপনার এই
“মানবাতা”র মূল্য দেবার মত দুঃসাহস তারা করবেনা!
আপনি ডাক্তার! দোকানে
গেলে, বাজারে গেলে, রেস্টুরেন্টে গেলে ভুলেও পরিচয় দেবেন না! তবে আপনার ট্যাক থেকে
বেশী খসবেই, “আপনি ডাক্তার আপনার কি টাকার অভাব আছে”! কিন্তু আপনার কাছেই যখন ঐ
ব্যক্তি রোগী হয়ে আসবে তখন সে যে আপনার পরম আত্মিয়, খুব কাছের লোক তা আপনি ভুলে
যেতে পারবেন না, তারা প্রমাণ করে দেবে আপনি তাদের কত আপনজন! আরে, আপনজনের কাছ থেকে
ভিজিট নিবেন আপনি তো আর অত “খারাপ” না!
এইভাবেই চলে যায়
“ডাক্তারের দিনরাত্রি”!
01.07.2015
ডা. আহমেদুর রহমান সবুজ